Sunday, December 29, 2013




 প্রেমের সমাধি তীরে

গত সপ্তাহান্তে গিয়েছিলাম পেন্সিলভেনিয়ার স্টেট কলেজে ভাইঝির কাছে  । মাত্র ক’দিন আগে সে তার গবেষণার কাজ শেষ করতে পেরে একেবারে গার্ডেন – দিল হয়েই ছিল ,তার ওপরে দীর্ঘ দিন পরে আমাদের কাছে পেয়ে সে খুশীতে ডগমগো । বললে “চল তোমাদের একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখিয়ে আনি”।

এদেশে পড়তে এসে ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের সুবিধে হবে বলে বেশ ভাল অবস্থায় থাকা ঢাউস একখানা গাড়ি কিনে ফেলেছিল । এবার সেই গাড়িতে আমাদের বসিয়ে নিজে স্টিয়ারিং এ গিয়ে বসল । গাড়ি ছুটে চলল শহরের বাইরে বড়রাস্তায় । সাঁই সাঁই করে পিছনে সরে সরে যাচ্ছে একটার পর  একটা সুন্দর সাজান গ্রাম । সে গ্রামের সঙ্গে আমাদের দেখা গ্রামের মিল পাওয়া দুস্কর । মাইলের পর মাইল সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর – তারই মাঝে মাঝে এক একটা ভিলার মত বাড়ি । কোনটা ছোট আবার কোনটা বেশ বিশাল মাপের । মনে হয় যেন কোন সম্পন্ন মানুষের বাসস্থান । ভাইঝির ধারাভাষ্যে জানা গেল বাড়িগুলি সব এখানকার চাষীদের । ভাইঝির জ্যাঠাইমার বিশ্বাস হয়না । বলে – হ্যা!! এই গুলো নাকি সব চাষীদের বাড়ি !” আমি বিজ্ঞের মত ফোড়ণ কাটলাম “আরে চাষী বলতে দেশে আমরা যাদের বুঝি ,এরা কি আর তেমন চাষী?দেখোগে যাও এদের প্রায় সকলেরই বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা সবি আছে আর এদের অনেকেই যথেষ্ট ধণী ও । শুধু চাষবাসের সুবিধে হবে বলে বড় শহরে না থেকে এই রকম জায়গায় বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে”।

সুন্দর বাঁধান রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটেছে এবার দুপাশে দেখা যাচ্ছে ভুট্টা চাষের ক্ষেত । ফসল উঠে গেছে – ন্যাড়া ক্ষেত জুড়ে পড়ে আছে ভুট্টাগাছের হলুদ গোড়াগুলি – আমাদের ধানকাটা হয়ে যাবার পর পড়ে থাকা খড়ের গোড়া বলেই ভুল হয় দূর থেকে । পথে যেতে যেতে একটা জায়গায় দেখা গেল বেশ সুন্দর একটি ঘোড়ায় টানা কোচ গাড়ি চলেছে গড়গড়িয়ে । ছোট্ট কোচটিকে পেরিয়ে যেতে গিয়ে এক ঝলক নজরে এল কোচের ভিতরে কয়েকজন সুসজ্জিত নারীপুরুষ চলেছে । ঘোড়ার নধরকান্তি চেহারা দেখে দুচোখ জুড়িয়ে গেল । তার কালচে গায়ের ত্বকে সূর্যের আলো যেন ঠিকরে পড়ছে । ভাইঝির ধারাবিবরণী চলছিলই – সে বললে “এরা বোধহয় আমিষ সম্প্রদায়ের লোক জন…” জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাতেই সে জানালো এদিকে কোথায় যেন কয়েকটা গ্রাম আছে যেখানে মানুষেরা আধুনিক প্রযুক্তিকে তাদের জীবনে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি । তারা বিজলিবাতি জ্বালায়না, অটোমোবাইল ব্যবহার করেনা ইত্যাদি ইত্যাদি”।

গল্পের ফাঁকে একটা জায়গায় চোখে পড়ল তারের জালের বেড়ায় ঘেরা  বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের মাঠে কালো কালো চমরি গাইয়ের মত এক দল বিশালকায় প্রাণী চরছে । ভাইঝি রাস্তার ধারে গাড়ি থামাতেই নেমে পড়ে বেড়ার কাছে গিয়ে দাড়ালাম । প্রাণীগুলিকে চমরী গাই এর মতই দেখতে , কিন্তু তাদের মধ্যে একটি অতিকায়  চেহারার  গাই ভীষন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শিং বাগিয়ে বেড়ার কাছে এসে মাটিতে শিং ঘষতে ঘষতে এমন ভঙ্গীতে নিজের অসন্তোষ ব্যক্ত করল তাতে মনে হল তারের বেড়া না দেওয়া থাকলে আমরা হয়ত বিপদে পড়ে যেতাম । পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হল ।

চমরী গাই দের দলটাকে পিছনে ফেলে আর কিছুদূর যেতে না যেতেই  দেখা গেল রাস্তা থেকে আনেকটা দূরে জঙ্গলের গাছগাছালির ফাঁকে একটি ধবধবে সাদা হরিণ একলা দাঁড়িয়ে যেন কিছু একটা চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে । এমন হরিণ আমি এই প্রথম দেখলাম । ভাল করে চার পাশটায় নজর করে দেখলাম সাদা হরিণছাড়াও বাদামি রঙের এক ঝাঁক হরিণ সামান্য দূরে ঘাসপাতা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীসুখ উপভোগ করছে । তাদের হাবেভাবে সাদা হারিণটির মত উদবেগের কোন লক্ষণ দেখলাম না । এখানেও আমার অভ্যাস মত কিছু ছবি তুলে নিয়ে আমাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম।

পার্কিং এ গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে ভাইঝি ঘোষনা করল “আমরা এসে গেছি পেন্স কেভ এ।এখানে আমরা বোটে করে একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে যাব – টানেলের ভেতরে দেখতে পাব minerals deposites কেমন অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেছে জায়গায় জায়গায়” । প্রায় পঞ্চাশ ডলার দিয়ে তিনজনের জন্যে টিকিট কেটে একটা ঢালু পথ বেয়ে নামতে নামতে গিয়ে পৌঁছলাম একটা গুহার মুখে । ভারি মিষ্টি চেহারার এক যুবক আমাদের অভ্যর্থনা করে বসালেন একটি বোটে। তিনিই একাধারে আমাদের মাঝি এবং গাইড । প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ হলে তিনি জানালেন আরো পনেরজন যাত্রী আসছেন ,তারা এসে গেলেই  আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে যাবে । মনে মনে ভাবছিলাম “এই রে ,  এ আবার সেই জামশেদপুরের অটোওয়ালাদের মত বসিয়ে রাখবে নাকি ! যতক্ষণ না “পাসিঞ্জার” ভরে যাচ্ছে ততক্ষণ সে গাড়ি ছাড়বেই না । অবশ্য সুখের কথা , বাকি পনেরজন পাসিঞ্জার এসে পৌঁছোতে সময় লাগলনা ।

বোট চালু করার আগে মুখবন্ধ হিসেবে গাইড সংক্ষেপে কিছু কিছু ব্যপারে আমাদের সতর্ক করে দিলেন। যেমন বোট সফর কালে কোন কারণেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়া যাবেনা , গুহার মধ্যে দেওয়ালে হাত দেওয়া যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি । তার পর মুচকি হেসে জানালেন  “ আপনাদের অবগতির জন্য বলি, যদিও যাত্রী সুরক্ষার খাতিরে সীটের নিচে লাইফ জ্যাকেট রাখা আছে  তবু নিশ্চিন্ত হবেন জেনে যে এই বোট সফরের বিগত  একশ বছরের ও অধিক কালের ইতিহাসে কোন যাত্রী কোনদিন জলে পড়ে জাননি । আশাকরি দয়া করে উত্তেজনার বশে আপনাদের মধ্যে কেউ প্রথম হতভাগ্যটি হবেননা ।

পেট্রল চালিত ইঞ্জিন চালু করে গাইড ধীরে ধীরে বোটটাকে অন্ধকার গুহার মধ্যে চালিয়ে নিয়ে চললেন । ওপরের ভূতল থেকে একশ ফুট নিচে সুড়ঙ্গের সামনের দিকে  জমাটবাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না ,বাদ বাকি যে দিকে তাকাই শুধুই পাথরের দেওয়াল – আর তার খাঁজে খাঁজে অন্ধকার ওৎ পেতে বসে আছে । কোথায় চলেছি কোথায় গিয়ে এ সুড়ঙ্গের শেষ জানিনা,বুকের ভেতরে কেমন যেন  গুরুগুরু মেঘগর্জনের শব্দ পাচ্ছি ।অন্ধকারের মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে গাইড একটা ইলেক্ট্রিক টর্চ জ্বালিয়ে পাশের পাথুরে দেওয়ালে আলো ফেললেন, অন্ধকারের অতল থেকে ভেসে উঠল তার কন্ঠস্বর ।

-“ওই দিকে চেয়ে দেখুন হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি অতি সঙ্গোপনে কেমন তিল তিল করে গড়ে তুলেছে আপন খেলাঘর । অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম অনুচ্চ ছাদ থেকে কেউ যেন ঝুলিয়ে রেখেছে সরুসরু পাথরের ঝালর । কোথাও বা পাথরের দেওয়ালে যেন মহার্ঘ রত্নহার টাঙ্গান । অল্পক্ষণের মধ্যেই আবিস্কার করলাম কখন জানিনা মনের যাবতীয় দুর্ভাবনা কর্পূরের মত উবে গেছে । আমি সুঢ়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অন্ধকারের অভিসার যাত্রাটুকু উপভোগ করতে আরম্ভ করেছি ।

সুড়ঙ্গপথে অতি ধীর গতিতে  এগোতে এগোতে একজায়গায় এসে আমাদের নাও থামল । গাইডবাবু  কোথায় যেন লুকিয়ে রাখা সুইচ টিপে লাল নীল আলো জ্বালিয়ে দিলেন। সেই রঙ্গীন আলোয় একদিকের দেওয়ালে ফুটে উঠল স্বপ্নের রাজপূরী । তার প্রবেশ তোরণের কি বাহার ।দুপাশে কারুকাজ  করা পাথরের থাম । মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করছিলাম এই প্রাসাদের কোন ঘরে সোনার পালঙ্কে  ঘুমিয়ে আছে রাজকন্যা । গাইড আমাদের কল্পনাকে একটু অন্য পথে চালিয়ে দিতে চাইলেন - পাথরের projection গুলি নাকি প্রায় একশ বছরে এক মিলিমিটার মত বাড়ে! তাহলেই কল্পনা করে নিন কত লক্ষ বছরে গড়ে উঠেছে এই প্রাসাদ আর তার প্রবেশ তোরণ !হিসেবটা মনে মনে কষতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেললাম । ভাইঝি পাশ থেকে ফুট কাটল “জ্যেঠু , এ আমাদের অঙ্ক কষিয়ে নিতে চায় গো” ।  গাইড তখনও ব্যখ্যা করে চলেছেন কোন পাথরের কি ধর্ম । কোনটা ক্যালসাইট।তার মধ্যে কোথায় একচাংড়া পাইরাইট এর ভেজাল মিশে গেছে , কি ভাবে তিলে তিলে mineral deposites বাড়তে থাকে ! কিন্তু সে কথায় কান দেবার মত মানসিক অবস্থা আমার ছিলনা । আমার মূগ্ধ চোখ রূপেই মোহিত ।

ভেলা ভাসিয়ে  আর কয়েক কদম এগিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন গাইড। চার পাশে একেবারে নিরন্ধ্র অন্ধকার ।গাইডের কন্ঠস্বর শোনা গেল –“আমরা এবার স্বর্গের বাগানে এসেছি ।কথা বলতে বলতে কোন অদৃশ্য খাঁজে হাত ঢুকিয়ে সুইচ টিপে দিলেন ,আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে সত্যি সত্যি এক অতি মনোরম বাগান জেগে উঠল । তার দূর প্রান্তে ঘন সবুজ নিবিড় বনাণী  মাঝে অনেকটা খোলা বাগানে যেন অসংখ্য অপার্থিব অবয়ব হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে ।আমাদের মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় দিয়ে গাইড আবার তার ধারা ভাষ্য শুরু করলেন । “এই সুড়ঙ্গটি শেষ হয়েছে একটি ছোট্ট ঝিলে কিন্তু দুদিন আগে পড়া বরফ গলা জল আর আগেরদিনের বৃষ্টির জল সবএসে জমেছে এই সুড়ঙ্গে তাই সুড়ঙ্গের জল অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে । এই অবস্থায় আমরা সুড়ঙ্গের অপর প্রান্ত অবধি যেতে পারবনা”। সত্যিই সুড়ঙ্গের মধ্যে বেশ কয়েকটি বাঁকেঅদূরে দেখিএক অতিকায়  তিমি মাছ হাঁ করে যেন আমাদের ভেলা সুদ্ধ গিলে ফেলার অপেক্ষায় রয়েছে ! তার কন্ঠনালী ঘন অন্ধকার – ওই ছিদ্র পথ পার হয়ে যাওয়া সত্যিই দুস্কর । আর ইতিপূর্বেই বেশ কয়েকটি বাঁকে মাথা বাঁচানর জন্যে আমাদের সামনের  দিকে ঝুঁকে মাথা নুইয়ে পার হতে হয়েছে । গাইড আমাদের আরো জানালেন যে সেদিন সকালেই তিনি তার বান্ধবীকে নিয়ে এই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে একেবারে ঝিল অবধি যাবার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু কিছুটা জলেরতল এবং প্রবল স্রোতের কারণে এখান থেকে আর এগোতে না পেরে ফিরে গিয়েছিলেন । এখান থেকে ফিরতি পথ ধরতে যাত্রীদেরও কেউই আপত্তি জানাল না ।  

গাইড এবার বললেন পরিশেষে এই সুড়ঙ্গ পথ কে ঘিরে একটা প্রেমের কাহিনী জুড়ে আছে। ফেরার আগে আপনাদের সেই কাহিনীই পরিবেশন করি ।

 আজ থেকে তিনশো বছর আগে পেন্সিলভেনিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখনও সভ্যতার আলোক এসে  পৌঁছয়নি । বনজঙ্গলে ভরা এই সব এলাকায় ছিল রেড ইন্ডিয়ান দের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বসবাস । তেমনি একটি গোষ্ঠীর ডেরা ছিল কাছেই অধূনা বেলফন্ট এ । গোষ্ঠীর মুখিয়া ও-কো-চো । তার ছিল সাত ছেলে  আর নিটানি নামে পরমা সুন্দরী এক কন্যা । সাত ভাই তাদের ছোট বোনকে যত্নে আদরে সদা সর্বদা ঘিরে রাখত । যাতে বিপদের কোন আঁচ না লাগে তাদের ছোট বোনটির গায়ে ।

সেই সময় এক বসন্ত প্রভাতে নিটানি গাঁয়ের ছোট্ট নদীটির ধারে দাদাদের শিকার করে আনা হরিণের চামড়া ধুতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ ই তার নজর পড়ল ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে এক সুদর্শন বিদেশী যুবক তার দিকে মূগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে । প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়ে গেল দুজনের । নিটানি জানতে পারল ঝর্ণার ও পাশেই যুবকটি তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করছে গত কিছু দিন যাবৎ । নিটানির প্রেমে পাগল ফরাসী আভিযাত্রী মালাচি বোয়ে তার প্রেমাস্পদকে পাবার আগ্রহে নানান উপঢৌকনে বশ করে ফেলল নিটানির বাবা ও-কো-চো কে । তাতেও বিশেষ সুবিধে হলনা কারণ অজ্ঞাতকূলশীল বিদেশী যুবকের হাতে কোন বাবা তার আদরের কন্যাকে তুলে দেবে । অগত্যা নিটানি এবং মালাচি বোয়ে একদিন কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ।

ভাগ্য বিরূপ ছিল নিটানি আর মালাচির । গাঁ ছেড়ে বেশী দূরে পালিয়ে যাবার আগেই তারা ধরা পড়ে গেল নিটানির দাদাদের হাতে । মুখিয়া ও-কো-চোর দরবারে । বিচার পর্ব শেষে সাজা ঘোষনা হল । বিদেশীকে কোনো একটি জলে ভরা অন্ধকার গুহায় ফেলে দেওয়া হোক যাতে সেই গুহার মধ্যেই তার মৃত্যু হয় ।

এই সেই গুহা যার মধ্যে নিটানির দাদারা মালাচি কে ফেলে রেখে গিয়েছিল এবং অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে যাবার পথ না পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই মালাচি মারা যায় । উপসংহারে গাইড বলেন – “জানেন তো আজও লোকে বলে এই গুহার মধ্যে কান পাতলে এখনও শোনা যায় মালাচির আত্মা নাম নিটানি... নিটানি ... বলে প্রেমিকাকে ডেকে চলেছে । এমনকি কোনও কোনও পাথরে হাত ছোঁয়ালে আপনারাও হয়ত নিটানির নাম শুনতে পাবেন । কিন্তু দয়া করে পরখ করার আগ্রহে কেউ সত্যি সত্যি পাথরে হাত দেবেননা যেন। মালাচি-নিটানির প্রেমগাথা স্মরনীয় করে রেখেছে পেন্সিলভেনিয়ার লোক।

মনে পড়ে গেল গুহায় নামার আগে ওপরের যে ঘরে টিকিট কেটেছিলাম তার এক ধারে কাচেঘেরা মালাচি বোয়ের একটি আবক্ষ মূর্তি দেখেছিলাম । পরে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গিয়ে Nitani lion এর পাথুরে মূর্তিও দেখেছি । এই Nitani Lion এর মূর্তি পেন্সিলভেনিয়া রাজ্যের emblem হিসেবেও ব্যবহার হয় । ঠাট্টা কিনা জানিনা ,গাইড জানালেন পেন্সিল্ভেনিয়ার অনেক প্রেমিক প্রেমিকা যূগলের বিয়ের অনুষ্ঠান এই গুহায় আয়জিত হয় । বোটের যাত্রীরা সমস্বরে গাইডের কাছে জানতে চাইলেন বান্ধবীর সঙ্গে তার বিয়েটাও কি এই গুহায় হবে ? মুচকি হেসে গাইড জানালেন তাদের ইচ্ছা অনেকটা সেই রকমই । আমরা ততক্ষণে ফিরে এসেছিলাম গুহার মুখে । এবার আমার কথাটি ফুরোল , নটে গাছটি মুড়োল ।

Monday, December 24, 2012

যেখানেতে অবাধ ছুটি

                                                                                          এক
এ বছরের গোড়া থেকেই আমাদের জেমস সায়েব আমাকে সমানে তাতাচ্ছিলেন দুজনে একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য। আমার মন এমনিতেই সর্বদাই উড়ুঊড়ু করতে থাকে ,এখন তার সঙ্গে যোগ হল জেমসের উস্কানি । আমায় আর পায় কে !তবে মুস্কিল হল গুপি-বাঘার মত ভুতের রাজার থেকে উপহার পাওয়া মন্ত্রপূতঃ জুতোজোড়া ত নেই আমাদের ,যে তা পায়ে গলিয়ে হাতে হাতে তালি বাজিয়ে পছন্দ সই জায়গায় পৌঁছে যাব মুহূর্তের মধ্যে ।কোথাও যেতে হলে সেই ভারতীয় রেলই ভরসা আমাদের । সময় থাকতে রেলের টিকিট কাটতে হবে ,খাজাঞ্চিখানায় খবর নিতে হবে ... সে ল্যাঠা অনেক ।
যাক যোগাড়যন্ত্র তো সারা হল,কিন্তু গোলবাধল নির্ধারিত দিনে বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশনে যাবার জন্য পথে বেরিয়ে । ২৫শে নভেম্বর যে মহরম - মুসলমানদের উৎসব টিকিট কাটার সময়ে সে খবর রাখিনি।মহরমের মিছিল এর যাত্রাপথ সুগম করার জন্য কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে শহরের কয়েকটি রাস্তায় যান চলাচলে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে ।ফলে যা হবার তাইই হয়েছে - রাস্তায় জ্যামের কারণে গাড়ি আর চলেই না ।এদিকে মহরমের খাতিরে ঘড়ি থেমে নেই।সময় এগিয়ে চলেছে তার আপন গতিতে ।আর গাড়ির ভেতরে স্থাণু হয়ে বসে আমি ঘেমে চলেছি - সময় মত হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে না পেরে শেষে ট্রেন ফেল না করি । অবশ্য ব্যপারটা অতদূর গড়ায়নি শেষ অবধি ।যথেষ্ট সময় হাতে থাকতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম হাওড়ায় ।
শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস গাড়িটা সম্পর্কে আমার মনে খুঁতখুঁতুনি ছিল কিছুটা ।গাড়িটা এমন এক লাইনে চলে যেখানে ধানবাদ এর পর থেকে একেবারে জবলপুর পৌঁছনর আগে অবধি একটাও ভদ্রগোছের স্টেশন পড়েনা ।উপরন্তু গাড়িটার সঙ্গে কোন প্যান্ট্রি কার ও নেই রাতের খাবার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই এ পথে । কিন্তু উপায় ও ছিলনা । টিকিট কাটতে গিয়ে এই একটি গাড়িতেই  আসন খালি পেয়েছিলাম ।তবে বেড়াতে বেরিয়ে এই রকম ছোটখাটো অসুবিধের পরোয়া করে কোন আহাম্মক । গাড়ি হাওড়া ছেড়ে লিলুয়া পার হয়েছে কি হয়নি জেমসের ঝুলি থেকে বেরোল একব্যাগ মুড়ি,চটপটা চানাচুর আর লাল রঙের এক প্লাস্টিকের ডাব্বা। সেই ডাব্বায় মুড়ি-চানাচুর মাখা হল বেশ তরিবৎ করে । পিএনপিসি সহযোগে মুড়িচানাচুর দেখলাম মন্দ লাগেনা । জেমস জানালেন তাঁর স্টকে পথশ্রান্তিহরা সাঞ্জীবনীসূধাও আছে - আমি নাকি ইচ্ছা করলেই তিনি তা নিবেদন করবেন আমার সেবার্থে ।জেমস সায়েবের বন্ধুপ্রীতি মুগ্ধ করলেও রেলগাড়ির কামরায় প্রকাশ্যে দ্রব্যটির সেবনে বিপদের আশঙ্কায় আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম ব্যপারটাকে আপাততঃ স্থগিত রাখতে ।
              ঠিক যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্য হল । সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এল, ট্রেনে কোন ভেন্ডারের দেখা নেই যার কাছ থেকে নৈশাহারের জন্য কিছু রসদ সংগ্রহ করি । তবু রক্ষে কোন একটা অপেক্ষাকৃত ছোট স্টেশন থেকে উঠল এক ভেন্ডার - তাও তার কাছে পাওয়া গেল শুধু নিরামিষ বিরিয়ানি । উপায়ান্তর না দেখে অখাদ্য সেই বিরিয়ানি গলাধঃকরণ করে ঝটপট শুয়ে পড়লাম ।একবার ঘুমিয়ে পড়তে পারলে আর খিদে পাবেনা রাতে । আলোটালো নিভিয়ে সামনা সামনি দুট নিচের বার্থে শুয়ে গল্প করতে করতে এক সময়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম । টের পাইনি পথে কোন এক স্টেশন থেকে ছানাপোনা আর মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে জনা পনেরোর একটা দল উঠেছে আমাদের কামরায় । তাদের পাহাড় প্রমান "মাল-সামান" জড়ো করেছে আমার আর জেমসের বার্থের মধ্যবর্তী খালি জায়গায় । ঘুম ভাঙল চোখে আলো পড়তে। একটি পনের ষোল বছরের মেয়ে সেই স্তুপাকৃতি বাক্সপ্যাঁটরার  থেকে একটা ব্যাগ টেনে বার করার চেষ্টা করছে ।আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে সে বলে ওঠে "চাচাজি ,আপকা সর উস তরফ কর লিজিয়ে ।ম্যায় আপনা ব্যাগ নিকালুঙ্গি"। একে তো কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাবার বিরক্তিতে মেজাজ তিরিক্ষে হয়েই ছিল তার ওপরে আমাদের কুপের অবশিষ্ট চারটি বার্থে সাত-আঠজনকে গাদাগাদি করে বসে থাকতে দেখে বুঝলাম রিজার্ভেশন থাকা সত্বেও এই দলটি যতক্ষণ না গাড়ি থেকে নামছে ততক্ষণ আমাদের চাপাচাপি করে বসতে হবে দিনের বেলা ।কথাটা মনে করেই খিঁচিয়ে উঠলাম মেয়েটিকে । কিন্তু আশ্চর্য কান্ড - মেয়েটি এতটুকু বিচলিত না হয়েই জবাব দিল " ব্যাগ নিকালতে সময় আপকো চোট ন লোগো যায় উসি লিয়েহি তকহ রহি হুঁ সর হটানে ।মাননা ইয়া না মাননা আপকি মর্জি ।আপকি ভলাইকে লিয়েই ত কহি"...। নাহ এ মেয়ের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবেনা ।চুপ করে শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম মেয়েটি কি করে। জেমসও ততক্ষণে সশব্যস্ত হয়ে পড়েছেন - তাঁর পাতা চাদরের ওপরে মেয়েটি একটি নোংরা ব্যাগ রেখে দিয়েছে! কি গেরো রে বাবা !
-"এই লড়কি..." মেয়েটিকে ডেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন মেয়েটিকে। সে তখন ওপরের বার্থে শায়িতা তারই কোন আত্মীয়ার সঙ্গে কথা বলছিল । কথা থামিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল - "মেরা নাম খুসবু হ্যায়।মুঝে উসি নামসে বুলাইয়ে দাদাজি" কথাটা বলেই সে আপন আত্মীয়ার সঙ্গে অসমাপ্ত কথপোকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার । জেমস নিচু স্বরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন "বাসু , এ যে একেবারে ধানি লঙ্কা দেখছি!"
         ঘুমের দফা রফা হয়ে গিয়েছিল আগেই ।কামরার ভেতরের অন্ধকারটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল ।সেই আলো আঁধারির মধ্যে নাকে নোলক পরা মুখটা ভারি ভাল লেগে গেল । মুখের কথায়"ধানি লঙ্কা" হলেও সে মুখে এমন এক নিস্পাপ সরলতা ছিল যে তাকে না ভালোবেসে থাকা যায়না । সকাল হতেই ভাব হয়ে গেল খুসবুর সঙ্গে । নিজের বার্থে উঠে বসে দেখি খুসবু সদ্য কেনা তার এক সেট জামা জেমসএর সামনে মেলে ধরে দেখাচ্ছে । পাশ থেকে আমিও দেখছি টের পাওয়া মাত্র এক ঝটকায় আমার দিকে ঘুরে বলে উঠল "আপকো নেহি দিখায়েঙ্গে"।তার ছেলেমানুষিতে আমি হেসে উঠতেই গলাটাকে নরম করে আবার বলে "আচ্ছা আপভি দেখিয়ে"। জানা গেল মাসি পিসি জ্যাঠা খুড়ো সব মিলিয়ে তারা জনা পঁচিশের একটা দল জয়পুরে কোন আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে চলেছে জয়পুর।আপাততঃ তারা কাটনি অবধি গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি বদল করে গন্তব্যে পৌঁছবে ।
রাত্রের বিরক্তি ভাবটা আমার কেটে গেছে খুসবু ও তার সঙ্গীরা ততক্ষণে এসে বসেছে নিছের বার্থে - একটু চাপাচাপি হলেও দেখলাম গল্প করতে ভালোই লাগছিল ।খুসবু আর যাই হোক মুখরা নয় - বরং বেশ হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে । কথায় কথায় জানা গেল সে স্কুলে ক্লাস টেনএ পড়ে এবং সামাজিক সহবৎ জানে। জেমস দেখি তাঁর দেশের বাড়ি বনগাঁ থেকে আনা মাখা সন্দেশ এর একটা বড় ডেলা বের করে খুসবুকে দিলেন তার পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে ভাগ করে খাবার জন্য ।
"থ্যাঙ্ক ইউ দাদাজি" বলে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পাশে বসে থাকা দলের অন্যান্যদের সন্দেশ বিতরণ করতে। খুসবুর মাসি অল্প বয়সী হলেও বোধ হয় অচেনা দুই পুরুষের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলতে সঙ্কোচ বোধ করছিল ।সে আমাদের শুনিয়ে খুসবুকে বলে "খুসবু পুছ,উনকা খানা ত হম খা রহি হু।ওহ হমারে খানা স্বীকার করেঙ্গে তো" কথাটা কানে যেতেই খুসবু দেখি তড়বড়িয়ে উঠে কামরার পিছন দিকে চলে গেল এবং ফিরে এল একটি কাগজের প্লেটে দুটো কালোজামুন আর নিমকী সাজিয়ে ।  মিষ্টিমুখ সারার পর আমরা দুজনে যেন পরিবারটির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলাম । একসময়ে দেখি জেমস তাঁর পকেট থেকে একটা সুদৃশ্য কলম বের করে উপহার দিলেন খুসবুকে ।খুসবুও তার পাতানো দাদাজির উপহার পেয়ে মহা খুশী বেশ অনেক্ষণ ধরে কলমটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজের ব্যাগে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখল ।
ভালোই কাটছিল সময়টা গল্পেগুজবে।এক সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছল কাটনি ।সেখানেই নেমে গেল খুসবুরা ।এখন তারা অপেক্ষা করবে জয়পুরের গাড়ির জন্য আমরা এগিয়ে চলব আমাদের গন্তব্যে ।সত্যি বলতে কি অরা নেমে যেতে আমার নিজেরই মনে হচ্ছিল কামরাটা যেন বড্ড খালি হয়ে গেল ।
          কাটনি ছাড়ার পর গাড়ি চলেছে তো চলেইছে - পথ আর ফুরয়না । বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ আমাদের পৌঁছনর কথা জবলপুরে কিন্তু গাড়ির গদাইলস্করী চাল দেখে আমরা যে সেই নির্ধারিত সময়ে পৌঁছব সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম । আমার উল্টদিকের বার্থে লম্বা হয়ে শুয়ে জেমস দেখি কি একটা পত্রিকায় মনোনিবেশ করেছেন ।আমায় উসখুস করতে দেখে পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে স্বগতোক্তি করার ভঙ্গীতে বলে উঠলেন "বুঝলেন বাসু , ওই খুসবু নামে মেয়েটি একদিন বড় হবে,স্কুলের গন্ডী পার হয়ে কালেজে যাবে - বিএ পাশ করবে তার পর হয়ত বাড়ি থেকে ওর একটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে ।বিয়ে করে খুসবু শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে সংসার করতে। তারপর কোন এক দিন হঠাৎ তার পুরনো জিনিষ পত্রের মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়বে আমার উপহার দেওয়া পেন -খুসবুর কি সেদিন কি তার নতুন করে মনে পড়বে এই ট্রেন জার্নির কথা ?মনে পড়বে এই পাতানো দাদাজির কথা ?"
জেমসের কন্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যা আমার অন্তর ছুঁয়ে গেল । জেমসের সঙ্গে আমার আলাপ চ্যাটের আড্ডায় - হাল্কা রঙ্গরসিকতার পরিবেশে ।এ এক নতুন জেমস । আমার জানা  জেমসের সঙ্গে আজকের এই জেমসের মিল খুঁজে পেলামনা কোন ।  
                                                                                             দুই
অবশেষে গদাইলস্করী চালে গাড়ি যখন জবলপুর স্টেশনে গিয়ে থামল বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে । দিনের এই সময়টায় কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার ঘরের বাইরে কিছুটা অস্থির লাগে । সেই অস্থিরতার তাড়ণাতেই বোধ হয় আমাদের একটা মাঝারি দামের পছন্দসই হোটেলে পৌঁছে দেবে সেই ভরসায় একটি অটতে চড়ে বসলাম । তাড়াহুড় করলে যা হয় আর কি - স্টেশন চত্বর থেকে খানিকটা যাওয়া মাত্র সে অটোর ইঞ্জিন বিকল হল । কিছুতেই সে আর স্টার্ট নেয়না। অটো চালক তখন অবাধ্য গরুকে যেমন গলায় দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে গোয়ালে নিয়ে যায় লোকে তেমনি অচল অটোটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল একটি হোটেলের সামনে । জেমস গেলেন হোটেলের ভেতরে ঘর পাওয়া যাবে কিনা এবং পাওয়া গেলে কেমন ব্যবস্থাপাতি তাই সরেজমিনে দেখে নিতে । মালপত্রের জিম্মায় আমি বসে রইলাম গাড়ির ভেতরে। অল্প সময়ের মধ্যেই জেমস ফিরে এলেন ।জানালেন হোটেলটার সব ভালো ,কিন্তু বাথরুমটা বাজে ।অতয়েব নাকচ সে হোটেল । অটো চালক এবার অন্য একটি অটোতে আমাদের বসিয়ে নিয়ে চললেন অন্য একটি হোটেলে। এমনি দুটি হোটেল নাকচ হবার পরে তৃতীয় হোটেলটা মোটামুটি পছন্দ হয়ে গেল জেমসের । অটো অয়ালাকে বিদায় করে আমরা থিতু হলাম হোটেলে ।
আশ্রয়ের ব্যবস্থা পাকা হতেই জেমসের মনে পড়ল বোতলে ভরা বিশুদ্ধ পানীয় জল ,আর আমার মনে পড়ল সিগারেট কেনার কথা । হোটেলের বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল হোটেলের রেস্তোরাঁয় বিশুদ্ধ পানীয় জলের বোতল মিলবে আঠেরো টাকায় ! "হাওড়ায় আমরা জলের বোতল কিনেছি বারোটাকায় ,আর এরা চায় একেবারে আঠের টাকা ! এ শ্লারা চোর ,বুঝলেন বাসু ।চলুন বাইরে অন্য কোন দোকানে খোঁজ করি "। সিগারেটের সন্ধানে আমাকে বেরোতেই হত কাজেই আমার আপত্তি ছিলনা। কিন্তু হোটেল থেকে বেরোনর মুখেই বাধা পেলাম রিসেপশনে কর্তব্যরত বয়স্ক ভদ্রলোকের কাছে ।  তাঁর চোখে মুখে কি যেন আতঙ্কের ছায়া । নীরস মুখে আমাদের নির্দেশ দিলেন হোটেল ছেড়ে বাইরে বেশি দূরে না যেতে। শহরের অবস্থা নাকি উদ্বেগজনক । সেই দিনই দুপুরে মহরমের মিছিলকে কেন্দ্র করে দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে কিছু ঝামেলার দরুণ শহরে উত্তেজনা আছে এবং সেই থেকেই হটেলের অদূরের একটি বিশেষ এলাকায় লোকজন চলাচলের ওপরে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে পুলিশের তরফ থেকে।
মনটা বেজায় দমে গেল আমার । এত দূর থেকে অনেক কষ্টকরে বেড়াতে এসে শেষ পর্যন্ত হোটেলের ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে আমাদের ? রিসেপশনের ভদ্রলোকের কাছেই জানতে চাইলাম "কাল সকালে কি তাহলে আমরা বেড়াতে বের হতে পারবনা ?" ভদ্রলোক বিরস বদনে উত্তর দিলেন "দেখুন কাল সকালে কেমন অবস্থা থাকে । তবে আপনারা যাবেন ভেড়াঘাটের দিকে।সেদিকে গন্ডগোল নেই । তবে এখনি আগাম কিছু বলা যাবেনা নিশ্চিত করে।"
বুঝলাম ভদ্রলোককে আর প্রশ্ন করে লাভ নেই ।জেমস ততক্ষনে জলের বোতল কিনতে বাইরে বেরোনর পরিকল্পনা ত্যাগ করে আঠেরোটাকা দিয়েই জলের বোতল কিনতে মনস্থির করে ফেলেছেন । আমাকে বাইরে যেতেই হবে সিগারেটের জন্য ।জেমসকে অপেক্ষা করতে বলে বেরোলাম বাইরে ।কিন্তু রাস্তায় পা রেখেই আবিস্কার করলাম রাস্তা অতি দ্রুত ফাঁকা হয়ে আসছে।মাত্র দশ মিনিট আগেও রাস্তায় যে পরিমান গাড়ি চলছিল এখন তার ভগ্নাংশ মাত্র রয়ে গেছে -তাও তারাও যেন যত দ্রুত সম্ভব আপন ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে পারলেই বাঁচে। একে একে ঝাঁপ নামিয়ে দোকানদারেরা বাড়ি ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । রাস্তাটা পেরিয়ে ওপারে একটা দোকানে সিগারেট পাওয়া যাবে অনুমান করে আমি রাস্তা পার হবার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময়ে পিছন থেকে জেমসের ডাক কানে এল -"বাসুউউউউউউ ,শহরে কার্ফু জারি হয়েছে । এখনি ফিরে আসুন হোটেলে ।" হঠকারিতা করে বিপদে পড়ার চেয়ে বন্ধুর পরামর্শ মত হোটেলের আপাত নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে ফিরেই এলাম ।আমি হটেলের মধ্যে ঢোকা মাত্র দেখলাম সিকিউরিটির লোকটি হোটেলের সামনের কোলাপ্সিবল গেটের ঝাঁপ বন্ধ করে দিল । নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমারও যে একেবারেই চিন্তা হচ্ছিলনা তা নয় ।তবে জেমস দেখলাম সত্যি অত্যন্ত ঘাবড়েছেন । "মাথায় থাকুক ধুঁয়াধার আর ভেড়াঘাট। আপনি বাঁচলে বাপের নাম ।কাল সকালে আমি হোটেল ছেড়ে এক পাও নড়ছিনা।"
সে আর এক নতুন ফ্যাসাদ ।জেমসকে যতই বোঝাতে যাই যে আমার ধারণা কাল সকালের মধ্যে অবস্থা সামলে নেবে প্রশাসন ।আমাদের ও বেড়ান পরিকল্পনা মাফিকই চলবে । জেমসের সেই একই কথা ।এই ঝামেলার মধ্যে তিনি হোটেলের বাইরে কিছুতেই পা রাখবেন না। ব্যপারটার মীমাংসা তখনি হবার নয় বুঝে আমি লঘুস্বরে বললাম "আজ সারা রাত জুড়ে আসুন আমরা দুজনেই থ্রী ইডিয়টস সিনেমার নায়ক আমির খানের মত মনে মনে "অ্যাল ইজ ওয়েল" মন্ত্র জপতে থাকি ।আমি নিশ্চিত তার সুফল আমরা পাবই । এখন বার করুণ আপনার পথশ্রান্তিহরা সঞ্জীবনী সূধার বোতল খানি ।আজকের রাতটা অন্তত কাটুক শান্তিতে ।     ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনেক ভোরে তবু গড়িমসি করে বিছানায় শুয়ে শুয়েই উদগ্রীব কান পেতে রেখেছিলাম রাস্তায় গাড়িঘোড়া আওয়াজ শুনতে পাবার আশায় ।আগের রাতে যতক্ষন না ঘুম এসেছে ততক্ষন রাতের নীরবতা ভেদ করে মাঝে মাঝেই কানে আসছিল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলা পুলিশের গাড়ি অথবা এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ ।আশঙ্কা জাগছিল এবারের বেড়াতে আসাটা বুঝি ভেস্তেই গেল । কিন্তু এখন এই ভোরের বেলা দুই একটা ট্রাক বা বাসের হর্ন যেন কানে আসছে !উৎসাহে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে । বাইরে বেরিয়ে একবার সরেজমিনে দেখে আসতেই হবে অবস্থাটা ।বেরোতে যাব এমন সময়ে জেমসের ডাক -"বাসু বাইরে যাচ্ছেন?দাঁড়ান  আমিও আসছি।"
হোটেল ছেড়ে বাইরে আসা মাত্র মনটা খুশি হয়ে উঠল আপনা হতে।  ভারি সুন্দর ঝকঝকে সকাল - গত রাতের আতঙ্কের চিহ্ন মাত্র নেই কোথাও ।সামনের রাস্তা দিয়ে দুই একজন সাইকেল আরোহী দিব্বি খস মেজাজে চলেছে আপন আপন গন্তব্যে । কিছু অটোরিক্সাও দেখলাম চলছে । হোটেলের ঠিক পাশেই একটা সরু গলির মুখে কয়েকজন দাঁড়িয়ে জটলা করছে,প্রথম সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে তাদের গায়ে ।এগিয়ে গেলাম জটলাটিকে লক্ষ্য করে । ওদের কথাবার্তা থেকে শহরের বর্তমান হালহকিকত হয়ত মালুম হবে । অহো ! একি দেখি ! জটলার ঠিক পিছনেই গলির মধ্যে একটা ঠেলা গাড়িতে গ্যাসের চুলায় তৈরী হচ্ছে গরমাগরম চা !উৎসাহে উত্তেজনায় জেমস প্রায় চেঁচিয়ে ওঠেন -"বাসুউউউউ চা আআআ।" জেমসের উত্তেজনা অবশ্য একেবারে অহেতুক নয় । গত কাল সন্ধ্যায় হোটেলের ঘরে ঢুকেই এক পট চায়ের অর্ডার দিয়েছিলাম ।চল্লিশ না পঁয়তাল্লিশ টাকায় পেয়েছিলাম দেড়কাপ মাতা আতি আখাদ্য চা । রাতের খাবার ও তেমনই।জেমস তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন "এ শালার হোটেলে আর কিছু খাবোনা।"
"আপনি একটু দাঁড়ান,আমি রুম থেকে আমার কাপটা নিয়ে আসি ।"বলে জেমস একছুটে চলে গেলেন তার কাপ আনতে ।ইতিমাধ্যেই আমি আবিষ্কার করেছি যে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে জেমসের একটু খুঁত খুতুনি আছে -যা প্রায় সাবেক বাঙালী ঘরের বিধবাদের ছুঁৎমার্গ কেও হার মানায় ।তাড়াতাড়িই ফিরে এলেন জেমস ।তাঁর হাতে একটা ঢাকনা দেওয়া প্লাস্টিকের গ্লাস । বললেন "এই দেখুন আমার কমন্ডলু ,আমি এতে করেই চা খাব"। জেমসের এই কমন্ডলু নিয়ে যতই ঠাট্টা কারিনা কেন পরে এই কমন্ডলু অনেক কাজে লেগেছিল ,কিন্তু সেকথা পরে হবে । হাল্কা শীতের আমেজের সঙ্গে গরম চা বেশ আয়েস করেই খাওয়া হল । চা খাবার ফাঁকে আমি নজর রেখেছিলাম রাস্তার দিকে। অদূরে একটি রাস্তার মোড়ে এক দল পুলিশ ব্যারিকেড অতিক্রম করে কোন যানবাহন যেতে দিচ্ছেনা বটে,কিন্তু পায়ে হেঁটে অনেকেই অবাধে যাতায়াত করছে সেখানে। বুঝলাম গন্ডগোলটা ওই এলাকাতেই হয়েছে এবং ওই বিশেষ অঞ্চলটি বাদে  রাস্তায় লোক চলাচল স্বাভাবিক বলেই মনে হল। অনুমান করলাম নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই আমাদের ।
            জবলপুর শহর থেকে বাইশ কিলোমীটার দূর ভেড়াঘাট।  পথে আমরা পিসান নামে একটা জায়গায় অল্প কিছুক্ষণের জন্য থেমে পিসানের "শঙ্করজির" দর্শন সেরে নিলাম । কাঁটা তারের বেড়া ঘেরা একটা বিশাল বর্গাকার ঘাসের লনের ওপ্রান্তে এক বিশালায় ধ্যানমগ্ন শিবের  মূর্তি -এই হল পিসানের শঙ্করজি ।একমাত্র  আকৃতির বিশালত্ব ছাড়া তার আর কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লনা । সেখান থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম ভেড়াঘাটের উদ্দেশ্যে ।
      আরবী ভাষায় জবল শব্দের অর্থ নাকি পাথুরে জমি । সেই শব্দ থেকেই নাকি উদ্ভব শহরের জবলপুর নাম । অবশ্য নাম নিয়ে অন্য একটি মতের কথাও শুনেছিলাম । ব্রহ্মর্ষি জাবালীর তপস্যা ক্ষেত্র ছিল পাহাড় জঙ্গল ঘেরা এই অঞ্চল । সেই পূণ্যাত্মার নামেই শহরের নামকরণ হয়েছে । বিষয়টি সম্পর্কে জেমসের মতামত নেব বলে কথাটা পাড়তে গিয়ে দেখি গাড়ির চালক জিতেন্দ্র গাড়িটাকে একটা সিমেন্টা বাঁধান বড় চত্বরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে ।আমরা পৌঁছে গেছি ধুঁয়াধার জলপ্রপাতের কাছে । আমাদের আগেই আর অনেক পর্যটকই দেখি পৌঁছে গেছে - বাঁধানো চাতালে অসংখ্য গাড়ি আর টুরিস্ট বাসের মেলা । জিতেন্দ্র জানাল আমরা জলপ্রপাতের ধার থেকে না ফেরা অবধি সে গাড়ি নিয়ে এই পার্কিংএ অপেক্ষা করবে । আমরা নিশ্চিন্ত মনে হাঁটা দিলাম ধুঁয়াধারের দিকে । পার্কিং থেকে ধুঁয়াধার জলপ্রপাত অবধি চলার পথের দুইপাশ জুড়ে বসেছে পাথরের তৈরী নানান দেবদেবীর বিভিন্ন মাপের মূর্তি আর ঘর সাজানর সৌখিন জিনিষ পত্রের দোকান ।  দেখলাম নিজের নাম লেখা ছোট ছোট শ্বেত পাথরের ফলক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় । দাম সামান্যই ।আর নিজের নাম খোদাই করিয়ে নেবার জন্য অপেক্ষা করার ও প্রয়োজন নেই । একটি কাগজে নিজের নামটি লিখে ফলকের দামবাবদ দেয় অর্থ দোকানিকে ধরিয়ে দিয়ে চলে যান জলপ্রপাত দর্শনে ।ফেরার পথে কেবল সংগ্রহ করে নিতে হবে ফলকটি । ভাবনাটা মন্দ নয় - নাম লেখা একটা  শ্বেতপাথরের ফলক আত্মীয়বন্ধুদের জন্যে একটা ভাল উপহার হিসেবে গণ্য হতে পারে । কিন্তু তৈরী করে রাখা কিছু ফলকের গায়ে মোটাদাগের নাম লেখার ধরণ দেখে ভক্তি হলনা । তাই বহু দোকানির অনেক সাধ্যসাধনা সত্বেও আমরা ঘাড় পাতলামনা ।
         দোকানের সার পেরিয়ে একটু এগোতেই অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা থেকে দেখতে পেলাম নর্মদার বিপুল জলরাশি প্রবলবেগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে খাদের মধ্যে । গুটিগুটি পায়ে  আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম একেবারে জলপ্রপাতের ধার ঘেঁষে । লোহার রেলিং দিয়ে সুরক্ষিত বেশ সুন্দর করে বাঁধান ঘাটে দাঁড়িয়ে ভয়মিশ্রিত বিষ্ময়ে চেয়ে রইলাম সফেন জলধারার দিকে । কি দুরন্ত বেগ তার !আমাদেরা বাঁদিক থেকে  নৃত্যপরা নর্মদা নদী  হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছে অতল গহ্বরে । জলপ্রপাতের পরিমন্ডলে সুক্ষ্ম জলকণারা একটা আস্বচ্ছ ওড়নার উড়িয়ে পরিবেশটাকে যেন আরো মোহময় করে তুলেছে । মনে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান - "ভীষণ আমার রুদ্র আমার নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার / উগ্রব্যথায় নূতন করে বাঁধলে আমার ছন্দ ।"
রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের  দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হচ্ছিল সত্যিই এই বিপুল জলরাশির প্রবল শক্তির কাছে কত ক্ষুদ্র আমাদেও অস্তিত্ব !নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম অনেক্ষণ ।
 বেশ কিছুটা সময় ধুঁয়াধার জলপ্রপাতের সামনে কাটিয়ে এবার নদীর গতিপথ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম । খরস্রোতা নর্মদা সফেন জলধারা ধুঁয়াধারকে পিছনে রেখে কিছুদুর এগিয়ে ঢুকে পড়েছে পাথরের উঁচু দেওয়াল ঘেরা নিরালায় । সেই নিভৃত নির্জনে নদী কুলুকুলু গান গায় আপন মনে - শ্বেত মর্মরে প্রতিধ্বণিত হয় তার সুর ।

                                                                                               চার

ধুঁয়াধার থেকে সামান্য দূরে ভেড়াঘাট যাবার পথে পড়ল চৌষট যোগিন মন্দির । একটা উঁচু টিলার মাথায় ওপরে মন্দির । মোট একশো আটটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে হবে শুনে জেমস রণে ভঙ্গ দিলেন । একাই এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির দিকে। হাঁপাতে হাপাতে একসময়ে পৌঁছেও গেলাম টিলার মাথায় । সামনেই  প্রাচীর ঘেরা চৌষট যোগিন মন্দির । মূল মন্দিরের কারুকাজ করা চুড়াটিই শুধু দেখতে পেলাম বাইরে থেকে । পাথরের প্রাচীরে একটা ছোট প্রবেশদ্বার । এতটাই ছোট সে দ্বার যে আমার মত খর্বকায় মানুষকেও মাথা হেঁট করে ঢুকতে হয় ।
 গোল মত মন্দির প্রাঙ্গনকে বেষ্টন করে থাকা প্রাচীরের গায়ে অজস্র খুপরিতে দেবী কালীর চৌষট্টি জন সহচরীর প্রস্তর মূর্তি বসান। তার অধিকাংশই অত্যন্ত জীর্ণ দশায় কোন মতে টিকে আছে । যতদূর জানি মন্দিরটি দশম শতাব্দীতে শিবভক্ত কালচুরিরাজ কেয়ূর বর্ষ স্থাপন করেছিলেন ।
    প্রায় জনহীন মন্দিরে বেশিক্ষন ভাল লাগলনা । মন্দিরে ঢোকার সময়ে জুতোজোড়া বাইরে খুলে রেখে গিয়েছিলাম , মন্দির থেকে বেরিয়ে প্রবেশ দ্বারের সিঁড়িতে বসে নিচু হয়ে জুতো পরতে পরতে কানে এল মহিলা কন্ঠ ।এক বয়স্কা মহিলা তাঁর  তরুণী কন্যাকে নির্দেশ দিচ্ছেন একটি বিশেষ গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে । কোন এক প্রাতিবেশীনির মুখে তিনি শুনেছেন গাছটি নাকি ভৃগু মুনির স্মৃতিধণ্য! বাইশ-তেইশ বছর বয়সী মেয়েটি মায়ের নির্দেশ অমান্য করলনা বটে ,কিন্তু যেমন দায়সারা ভঙ্গীতে নির্দিষ্ট গাছের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানাল তাতে ভৃগু মুনির আশীর্বাদ লাভের জন্য তার বিশেষ মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হলনা ।
আমার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটি বোধ হয় কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেছিল । অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাতেই যেন বলে ওঠে"মা ,তুমি এমন করনা ..." বাক্যটি অসমাপ্ত রেখেই  মা এবং পরিবারের আর পাঁচজনকে পিছনে ফেলে তরতরিয়ে সে নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ।
        রাস্তায় যেখানে জিতেন্দ্র যেখানে গাড়ি দাঁড় করাল সেখান থেকে  নদীর ঘাট বেশ অনেকটাই নিচুতে ।বেশ কিছু ধাপ সিঁড়ি ভেঙে তবে পৌঁছন যাবে নদীর ঘাটে । সেখানেই নৌকো পাওয়া যাবে মার্বল রকস দেখতে যাবার জন্য । "আবার সিঁড়ি ভাঙতে হবে! বাসু আপনি যান,আমি ওর মধ্যে নেই" সাফ জবাব জেমসের ।
জেমসকে বোঝাই নদীর দুই তীরে প্রকৃতি আপন খেয়ালে পাথরের যে অপূর্ব ভাস্কর্য রচনা করে রেখেছে তার এত কাছাকাছি এসেও সামান্য কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমের কথা ভেবে তাকে স্বচক্ষে না দেখেই ফিরে যাওয়াটা একান্তই বোকামি হবে । আমার কথায় কিছুটা নিমরাজি হয়েই জেমস আমকে অনুসরণ করে পা বাড়ালেন ঘাটের পথে ।
জনা পনেরো যাত্রী নিয়ে ঘাটে নৌকো অপেক্ষা করছিল ।কুড়ি জন যাত্রী না হলে নৌকো ছাড়বেনা । আমরা উঠে বসার পর আর তিন জন যাত্রী জোগাড় করতে মাঝিকে বেশি বেগ পেতে হলনা। হিন্দি ফিল্ম অভিনেতা শক্তি কাপুরের মত দেখতে এক ভদ্রলোক সস্ত্রীক উঠে পড়লেন নৌকায় । জেমস নৌকায় একটু ভেতর দিক করে বসেছিলেন ।আমার ঠাঁই  হয়েছিল নৌকার সামনের দিকে । জায়গাটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা -এখান থেকে বেশ ভালভাবে ছবি তুলতে পারব ভেবে মনে মনে বেশ খুশীই হয়েছিলাম ।কিন্তু ওমা ! শক্তিকাপুর মার্কা ভদ্রলোকের বিশালাকায়া স্ত্রী দেখি ধপ করে এসে বসলেন ঠিক আমারই পাশে । পেছন থেকে জেমসের রসাল মন্তব্য কানে এল - "ভাগ্য করে জন্মেছেন বটে বাসু ..."। পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে জেমসকে একটা জুতসই জবাব দিতে গিয়ে দেখি জেমস পায়ের জুতোজোড়া খুলে রেখে সীটে বসে দিব্বি ঠ্যাং নাচাচ্ছেন ! যে মানুষটা ঘাট অবধি আসতেই চাইছিলনা সেইই এখন নৌকায় বসে পরমানন্দে ঠ্যাং নাচাচ্ছে দেখে মজা লাগল ।  কৌতুক করে বললাম "আপনি দেখি একেবারে জুতোটুতো খুলে বেশ গুছিয়ে বসেছেন দেখছি !"
আমার কৌতুক গায়ে না মেখে জেমস বলে ওঠেন "আরে দূর... জুতো পরে কি আর সাঁতার কাটা যায় ? এই নৌকো মোটেই কুড়ি জন যাত্রী বইবার উপযুক্ত নয় । আতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের দরুণ যদি মাঝনদীতে নৌকো উলটে যায় ! সে ক্ষেত্রে আমি ভাই সটান জলে ঝপাং...।" হেসে বাঁচিনা জেমসের কথায় ।
       জলে আমার নিজেরই বেজায় ভয় । তবু সুন্দরের নিবিড় সাহচর্যের আকর্ষণ সাময়িক ভাবে আমার সেই ভীতিকে মনের পিছনে ঠেলে দিয়েছিল । এবার জেমসের কথা শুনে নিজের অজান্তেই আমার চোখ গেল নদীর জলের দিকে । সভয়ে দেখলাম নৌকার কিনারা থেকে নদীর জলের ব্যবধান এক কি দেড় ফুট মাত্র । কোন কারণে নৌকা যদি একটু কাত হয়ে পড়ে তা হলে সমুহ বিপদ । তাবে ঝুঁকির ভয়টা কতটা বাস্তব আর কতটাইবা কাল্পনিক তা স্থির করে ওঠা মুস্কিল । তাই একরকম জোর করে মন থেকে ওই ভাবনাগুলো সরিয়ে রাখলাম তখনকার মত।
ইতিমধ্যে নৌকা চলতে শুরু করে দিয়েছে । সামনের দিকে দুজন মাঝি দাঁড় বাইছে প্রাণপণে । নৌকার গতিও প্রাথমিক জাঢ্য কাটিয়ে বেশ তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে মাঝনদী বরাবর । ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে "বাবু অম্বিকা ব্যানার্জি ঘাট",নদী তীরের শিব মন্দির । অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নৌকা বেয়ে ঢুকে পড়েছি পাহাড়ি খাতে । দুপাশে এক কি দেড়শ ফুট মত উঁচু পাথরের দেওয়াল ঘিরে রেখেছে আমাদের । হলদেটে সাদা ডলোমাইট পাথরের গায়ে শিরা ফুটেছে কালচে সবুজ বা কালো আগ্নেয়শিলার । নৌকায় আমাদের কারো মুখে কথা নেই,শুধু ছলাৎ ছলাৎ দাঁড়ের শব্দ কানে আসছে মাঝে মাঝে। মাথার ওপরে নীল আকাশ নিচে সবজে নীল জল আর দুপাশে পাথরের দেওয়াল - সব মিলিয়ে  বেশ গা ছম ছম করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জবলপুরে আসছি শুনে অনেকেই বলেছিলেন চন্দ্রালোকিত পূর্ণিমা রাতে মার্বল রকস এর সৌন্দর্য নাকি পাগল করা । পাকে চক্রে সে দিনটাও ছিল পূর্ণিমা । কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সে অপার্থিব সৌন্দর্য ভোগ লেখা ছিলনা । শহরে অশান্তির পরিবেশে রাত্রে বেড়াতে বেরন কিছুটা হঠকারিতা হবে ভেবে  সে পথে হাঁটিনি আমরা ।
  ইতিমধ্যে মাঝিদের একজন ধারাভাষ্য দেওয়া শুরু করে দিয়েছে । তাদের মুখেই শুনছিলাম নদী কোথাও তিনশ কোথাও বা চারশ ফুট গভীর !পাশ থেকে কেউ বুঝি আঁতকে উঠল নদীর গভীরতার কথা শুনে । নদীর শান্ত নীল জলের দিকে চেয়ে আমার মনে হল পাঁচ কিম্বা ছফুট উচ্চতার মানুষের ডুবে মরার জন্য ছয় সাত ফুট গভীরতাই তো যথেষ্ট। তাই নদীর গভীরতা সেখানে তিনশো ফুট হোক বা,চারশো - তাতে ফলে কিছু ফারাক হবে কি?  
 বেশ অনেকটা দূর অবধি নৌকা বেয়ে আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখানে নদীর দুপাশের পাহাড় এমন এক গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছে যে সাধারণ যাত্রীরা নদীর বুকে পথ গুলিয়ে ফেলেন । মাঝি সহাস্যে আমার সামনের ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করল - "ইয়ে হ্যায় ভুলভুলাইয়া । ম্যাডাম,অব বোলিয়ে কিস তরফ যাউঁ ।"সত্যই নদীর এই অংশ ভুলভুলাইয়াই বটে - এখান থেকে পথ চিনে বেরন আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য । মাঝি তো আর যাত্রীদের ভরসায় নৌকা চালাতে জলে নামেনি সে ঠিকই জানে এ ভুলভুলাইয়ার রহস্য ।সে নৌকা বেয়ে চলে আর একটা বাঁকে এসে এক বিশাল শ্বেতপাথরের স্তুপ দেখিয়ে বলে "ইয়ে হ্যায় নন্দী ভগবান"সত্যিই তো ।পাথরের স্তুপটা দেখে সত্যিই মনে হচ্ছে যেন একটা অতিকায় ষাঁড় জলে গা ভাসিয়ে বসে আছে ! আর এক জায়গায় অমনি সাদা পাথরের ন্য একটি স্তুপ দেখে মনে হল যেন নর্মদার নীল জলে একটা ময়ূরপঙ্খী নৌকা দিব্বি হেলে দুলে ভেসে চলেছে !
ঘাট থেকে বেশ কিছুদূর অবধি নদীর জলে একটু সবুজ আভা ছিল । প্রায় আধঘন্টা মত নৌকা বেয়ে যেখানে আমরা এসে পৌঁছেছি সেখানে নদীর সুলেখা কালির মত ঝকঝকে নীল ।সেই নীল জলে নদীতীরের শ্বেত পাথরের ছায়া তিরতির করছে - এ যেন এক স্বপ্নের রাজ্য । কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজেকে বুঝি হারিয়ে ফেলেছিলাম ।সম্বিৎ ফিরল মাঝির কথায় ।
মাঝিকে নৌকা ঘোরাতে দেখে জানতে চেয়েছিল "আর আগে যাবেনা?এখান থেকেই ফিরবে?"রসিক মাঝি জবাব দেয় "আগে স্বরগদ্বার হ্যায় বাবুজি ।উধর যো যাতা হ্যায় ,ওয়াপস লৌটতা  নেহি"। ধুঁয়াধারের কাছে নর্মদার ভয়ঙ্করী মূর্তি যা দেখেছি তাতে বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়না মাঝি স্বরগদ্বারের কথা কেন বলল । নৌকা বাইতে বাইতে আমরা বোধ হয় সেই ধুঁয়াধারের কাছাকাছিই পৌঁছে গিয়েছিলাম । এখান থেকে আর এগিয়ে গেলে জলের প্রবল স্রোত  নৌকা সহ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভবনদীর পারে ।  তাই এখান থেকেই ফেরা শ্রেয় ।
                                                                                                পাঁচ
জলবিহার সেরে এবার আমরা ফিরে চললাম জবলপুর শহরের দিকে । পথে পড়ল ১১১৬ খৃষ্টাব্দে রাজা মদন শাহর তৈরী মদন মহল । এখানেও সেই সিঁড়ি দিয়ে ঊঠতে হবে পাহাড় চুড়ায় ।জেমস ও আমি উভয়েই ধীরে ধীরে উঠতে আরম্ভ করলাম ওপরের দিকে । গাইড বইয়ে দূর্গাবতী নামেএক রানীর উল্লেখ দেখেছিলাম । ১৫৬৪ খৃস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সৈন্যবাহিনীর হাতে পরাজয় নিশ্চিত দেখে নিজের গলায় অঙ্কুশ বিঁধিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন রাণী ।  সেই গল্প করতে করতে উঠছিলাম দুজনে ,হঠাৎ একটা বড় পাথরের চাঁই এর গায়ে হিন্দিতে লেখা বিচিত্র এক সতর্ক বার্তা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম দুজনে । -"ইস ক্ষেত্র কে পাস লড়কা লড়কি কা বৈঠনা এবং আপত্তিজনক স্থিতি মে বৈঠনা সখত মনা হ্যায় । পায়ে জানে পর সখত কারয়াবাই হোগি।" প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের নিভৃতে একে অপরের শরীরের উষ্ণতা উপভোগ করার পক্ষে পাথর জঙ্গলে ঢাকা এ এক আদর্শ কুঞ্জবন । কিন্তু হায়, নীতিবাগীশের রক্তচক্ষু এখানেও পিছু ছাড়েনা । পথ চলতে চলতে আরো দুই জায়গায় অনুরূপ দুটি সতর্কবার্তা চোখে পড়ল ।তার একটিতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে এই মর্মে যে "আপত্তিজনক" অবস্থায় ধরা পড়লে সোজা থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে ।অন্য আর একটি বার্তা বেশ মজাদার । সে বার্তায় বলা হয়েছে "আপত্তিজনক স্থিতি"তে ধরা পড়লে প্রেমিক প্রেমিকা যুগলকে নিয়ে "জুলুস"বার করা হবে ! আমি ও জেমস উভয়েই হেসে কুটিপাটি ।
            দম নেবার জন্য একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম । ওপরের দিক থেকে এক তরুন কে নিচের দিকে আসতে দেখে জানতে চাইলাম মদন মহল ঠিক আর কতটা দূরে । জবাব শুনে জেমসের তো চক্ষু ছানাবড়া । এতক্ষণে আমরা অর্ধেক পথ পার হয়েছি মাত্র ।  তবে তরুণটি জোরের সঙ্গে জানাল পথশ্রমের ভয়ে আমরা যেন মহলটি না দেখে ফিরে না যাই । জেমস আর এগোতে চাইলেননা ।বললেন "বাসু আপনি দূর্গাবতীর মহল দেখে আসুন ।আমি নিচে গাড়িতে অপেক্ষা করছি আপনার জন্য"অগত্যা আমি একাই সামনের দিকে এগিয়ে চললাম ।  সিঁড়ি শেষ হতেই খোলা সমতল প্রাঙ্গনের বাঁদিকে চোখে পড়ল একটা বিশাল পাথরের পিঠের ওপরে ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি । দেখে মনে হবে যেন পিঠের ওপরে জমকালো রাজকীয় হাওদা নিয়ে একটা  মস্ত হাতি আমার দিকে পিছন করে পা মুড়ে বসে আছে ।  হাতির সামনের দিকে একটা বিশাল উঁচু খিলান ওয়ালা দরজা -তার মাঝখানে ধাপে ধাপে সিঁড়ি । আর ডান দিকে এক বহু প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ । শুধু কয়েকটি দেওয়াল ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । কয়েক পা এগিয়ে পাথরের স্তুপটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম । অবাক হয়ে দেখলাম যে পাথরটাকে আমার আগের অবস্থান থেকে হাতির মত দেখাচ্ছিল এখন সেটা দেখাচ্ছে একটা হাঁ করা তিমি মাছের মুখের মত !

 বেশ কিছু উঁচু উঁচু সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পা রাখলাম মদন মহলের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছাদে । ছাদের এক ধারে নিতান্তই সাদামাঠা একটা দোতলা বাড়ি । ওপরের তলাটা বন্ধ ছিল সাধারণ দর্শকদের জন্য । একেবারে আড়ম্বরহীন নিতান্তই সাধারণ গেরস্ত ঘরের মত বাড়িটাকে রাজপ্রাসাদ বলে কল্পনা করতে কষ্ট হয় । মদনমহল আমাকে তেমন ভাবে আকৃষ্ট করলনা।শুধু রানীর মহল থেকে নিচে নেমে আসার সময়ে লক্ষ করলাম আধো অন্ধকার সিঁড়িটাকে । পাশাপাশি দুজন চলতে পারেনা এতটাই সরু সে সিঁড়ি ,আর ধাপগুলো একটা থেকে আর একটা বেশ নিচু। এই সিঁড়ি দিয়ে খুব দ্রুত চলাচল সম্ভব নয় । তবে কি সিঁড়িটা জেনানা মহলের সুরক্ষার কথা ভেবে ওই ভাবে তৈরী ?
মদন মহল থেকে বেরিয়ে আমরা ফিরে চললাম শহরের দিকে । পথে পড়ল পিসান জৈন মন্দির ।আমাদের চালক জিতেন্দ্রর আগ্রহে কিছুক্ষণের জন্য থামলাম সেখানে । এখানেও একটা টিলার মাথায় জৈন মন্দিরটি ।সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি আর সেই সঙ্গে প্রায় প্রতি জায়গায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতে করতে আমিও ক্লান্ত হয়েপড়েছিলাম । ঠিক করলাম আর সিঁড়ি ভাঙা নয় -টিলার পায়ের কাছে "ছোটমন্দির"টাই দেখে নিলাম আলগোছে।
                                                                                            ছয়
             দূরপাল্লার বাসে দরদস্তুর করে ভাড়া দেবার অভিজ্ঞতা আর কারো কোনদিন হয়েছে কিনা জানিনা ,সাতনা থেকে খাজুরাহো যেতে গিয়ে আমাদের সেই বিরল অভিজ্ঞতা হল । জবলপুরে আমাদের দুদিন থাকার কথা ছিল । কিন্তু একদিনেই তার প্রধান দর্শনীয় জায়গাগুলি আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল তাই হোটেলে ফিরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে জবলপুরে আটকে না থেকে পরের দিন সকালেই আমরা রওয়ানা হয়ে যাব খাজুরাহোর উদ্দেশ্যে । পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ভোর বেলা হোটেল ছেড়ে দিয়ে স্টেশন থেকে জবলপুর -রেওয়া  ইন্টারসিটি শাটল ট্রেন ধরে সাতনায় চলে এসেছিলাম । সাতনা স্টেশন থেকে বাস স্ট্যান্ডে এসে খবর পেলাম খাজুরাহোর বাস পেতে আমাদের দুপুর দুটো অবধি অপেক্ষা করতে হবে । অবশ্য স্টেশনে একটি প্রাইভেট গাড়িওয়ালা আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিল বারোশো টাকায় সে আমাদের খাজুরাহো পৌঁছে দেবে । আমাদের অনিচ্ছুক দেখে সে ভাড়া ন'শো টাকা অবধি নামতেও রাজি  হয়ে গিয়েছিল ।কিন্তু আমরা স্থির করে রেখেছিলাম কোন রকম বাবুয়ানি আমরা করবনা ,তাই আরামের হাতছানি উপেক্ষা করে একটা অটোতে করে বাস স্ট্যান্ডে চলে এসেছিলাম । যে রোগা পাতলা লোকটি আমাদের বাসের খবর দিয়েছিল বাসের টিকিট ও তারই কাছে পাওয়া যাবে বলে সে আমাদের জানিয়েছিল । ভাড়া লাগবে মাথাপিছু দেড়'শোটাকা ।
হিসেব করে দেখা গেল আমাদের হাতে তখন ও দুঘন্টার ও বেশি সময় আছে ।তাই তখনি টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই - কোথাও দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এসে পরে টিকিট কাটব স্থির করে লোকটির পরামর্শ মত আমরা স্ট্যান্ডেই একটা ছোট্ট খাবার দোকানে মাছভাত খেয়ে নিয়ে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে গিয়ে বসলাম ।
     দুপুর দুটোর পরে বাস এল কিছুটা দেরি করে । খালি বাস পেয়ে আমি ও জেমস উভয়েই দুটি খালি জানালার ধারের আসন দখল করে বসে পড়লাম । বাস ছাড়তে তখন ও কিছুটা দেরি আছে দেখে জেমসের মনে পড়ল পানীয় জলের বোতল কেনার কথা । তিনি "আসছি" বলে নেমে গেলেন এবং ফিরে এলেন জলের বোতলের সঙ্গে একটি মহামূল্যবান তথ্য নিয়ে । জল কিনতে গিয়ে তিনি নাকি অপর এক যাত্রীর মুখে শুনেছেন সাতনা থেকে খাজুরাহোর বাস ভাড়া একশো কুড়ি টাকা - দেড়শো নয় !"দেখেছেন বাসু ,ওই ছেলেটা আসলে একটা টাউট । ব্যাটা আমাদের থেকে তিরিশ-তিরিশ ষাট টাকা অতিরিক্ত ভাড়া নেবার তালে ছিল ।"
আমি তো অবাক ।এমনটাও হয় নাকি !তবে অবাক হবার পালা তখনো কিছু বাকি ছিল আমার । বাস ছাড়ার বেশ অনেক্ষণ বাদে পিছনের আসন থেকে জেমসের গলা পেলাম ।
"বাসু ,বাসের আসল ভাড়া কত জানেন ? আমি জবাব দিই "আপনিই ত খবর আনলেন ভাড়া একশো কুড়ি টাকা"
"দুররর ।তাহলে আর বলছি কেন । এই দেখুন মাথাপিছু একশোটাকা দিয়ে কন্ডাক্টারের কাছ থেকে আমি আমাদের দুজনের টিকিট কেটেছি ।কন্ডাক্টার ও আমাদের নতুন দেখে একশো কুড়ি হাঁকছিল ।আমি দরদস্তুর করে ব্যাটাকে একশোটাকায় রাজি করিয়েছি,দেখলেন কেমন দুজনের পঞ্চাশটাকা করে বাঁচালাম !"
 সাতনা থেকে খাজুরাহো একশো সতেরো কিলোমীটার রাস্তা পাড়ি দিতে বাসের লাগল চার ঘন্টার ও বেশি সময় । এমনিতেই একভাবে বসে থাকার একটা একঘেয়েমি আছে তার ওপর পথটাও একেবারেই বৈচিত্র্যহীন । অবশ্য মান্ডলা বাসস্ট্যান্ডের দিকে বাসটা যখন যাচ্ছিল তখন রাস্তার ধারে একটা বিশাল প্রাচীন মন্দিরের দেখা পেয়েছিলাম এক ঝলক । পরিত্যক্ত মন্দিরটার গড়ন বেশ সুন্দর লেগেছিল ।ভেবেছিলাম খাজুরাহো থেকে ফেরার পথে ওটা দেখে নেব ।তবে সে ইচ্ছাকে আর কাজে পরিনত করা হয়ে ওঠেনি আমার ।
      সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন খাজুরাহো বাসস্ট্যান্ডে নামলাম তখন আর অগ্রপশ্চাৎ ভাবার ইচ্ছা ছিলনা । একটা রিক্সায় চেপে সোজা গিয়ে হাজির হলাম মধ্যপ্রদেশ পর্যটন বিভাগ পরিচালিত ঝঙ্কার হোটেলে । বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিমছাম হোটেলটাকে ভাল লেগে গেল । হোটেলের সামনে বিশাল বাগান ,সবুজ ঘাসে ঢাকা লন আর ঘরখানিও বেশ বড় এবং সুসজ্জিত । ভাল হোটেল পেয়ে মনের যাবতীয় বিরক্তি কোথায় উধাও হয়ে গেল আমাদের দুজনেরই ।
খাজুরাহো বেড়াতে যাচ্ছি শুনে জনৈক বন্ধুপত্নী মুচকি হেসে প্রশ্ন করেছিলেন "ব্যপারকি বলুন তো ! এই বয়েসে খাজুরাহো বেড়াতে যাচ্ছেন -তাও বউদিকে না নিয়ে !" 
ইঙ্গীতটা না বোঝার ভান করে নিরীহ মুখে জবাব দিয়েছিলাম - "বেড়াতে যেতে হলে যে জিনিষগুলি লাগে,অর্থাৎ ইচ্ছা,অবসর ,যথেষ্ট অর্থ  এবং শারীরিক সক্ষমতা - তার সবকটিই যখন আমার আছে এবং ইতিপূর্বে আমি খাজুরাহোতে যাইনি কখন ও তখন বয়সের কথা ভাবতে বসব কেন ?তা ছাড়া আমি তো আর চপলমতি বালকটি নেই যে মন্দিরের মিথুনমূর্তি দেখে বিচলিত হয়ে পড়ব।" 
বন্ধুপত্নীকে দোষ দিইনা । বহু শহুরে শিক্ষিত মানুষের মনে খাজুরাহো মন্দিরের কথা উঠলেই রগরগে যৌনতার ভাবনাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায় । এমনকি খাজুরাহো থেকে সংগ্রহ করা একটি গাইড বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে একদা একদল নীতিবাগীশ লোক খাজুরাহ মন্দিরের মিথুনমূর্তিগুলিকে অশ্লীল ও আপত্তিকর আখ্যা দিয়েধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল একদা । বইটিতে একথাও লেখা হয়েছে যে সেই সব ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বঘোষিত রক্ষাকর্তাদের উদ্যমে নাকি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর সমর্থন ছিল । সংবাদটি পেয়ে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে একটি চিঠিতে জানান যে খাজুরাহোর মন্দিরের ভাস্কর্য আমাদের দেশের এক অতি মূল্যবান সম্পদ । কেবল মাত্র একশ্রেণীর ভারতবাসী তাঁদের পূর্বপুরুষদের যৌনতা বোধ সম্পর্কে অস্বোয়াস্তি বোধ করেন বলেই তাকে নির্মম ভাবে ধ্বংস করে ফেলা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হবে ।
(Even that great Victorian puritan Mohandas Karamchand Gandhi,found the temples deeply distressing and gave his blessing to a band of pious vandals who wanted to chip the walls of the temples clean from these “indecent and embarrassing” affronts to their ignorant notions about Indian culture. It took the intervention of no less than Rabindranath Tagore who wrote an appalled letter to Gandhi, explaining that this was a national treasure and could not be so cavalierly demolished because some people were uncomfortable that their ancestors were sexual beings)
খাজুরাহো মন্দিরের মিথুন মূর্তি গুলি নিয়ে বিতর্ক সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল আরো আগে । ঘন বনজঙ্গলে অন্তরালে লুকিয়ে থাকা বিস্মৃত পরিত্যক্ত মন্দিরগুলি উদ্ধার করেছিলেন Captain T.S.Burt নামে যে ইংরেজ রাজকর্মচারী তিনি তাঁর রিপোর্টে মন্দিরগুলি সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে একদিকে যেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন  Probably the finest aggregate number of temples congregated in one place to be met in all of India,and in an area within a stones’s throw of one another.তেমনি আবার কিছু কিছু মূরতি যে তাঁর চোখে extreamly indecent and offensive ঠেকেছিল তাও জানাতে ভোলেননি ।
         
                                                                                  সাত
     

              ইতিহাস বলে খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দী অবধি চন্দ্রবংশীয় চান্দেল রাজাদের রাজত্ব্যকালে 'খেজুরবাটিকা'অঞ্চলে মোট পঁচাশিটি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল।  ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ দেখে জানা যায় যে দশম শতকের প্রথম দিকে নানুক নামে জনৈক সামন্ত রাজা ছিলেন চান্দেল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । সেই বংশের পঞ্চমপুরুষ হর্ষদেবের  রাজত্ব্যকালে খৃষ্টীয় ৯১৫ সাল নাগাদ সম্ভবত মাতঙ্গেশ্বর শিব মন্দির স্থাপিত হয় । এবং মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরকে অনুসরণ করে উত্তরকালে একের পর এক মন্দির স্থাপনার পর্বের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু ইতিহাসের কথা আপাতত তোলা থাক।আমরা নজর দিই খাজুরাহোকে ঘিরে যে চিত্তাকর্ষক লৌকিক প্রেম কাহিনী পল্লবিত হয়ে এসেছে সেই আদিযুগ থেকেই,তার দিকে ।
    কোন এক গ্রীষ্মের রাতে কাশীর রাজা ইন্দ্রজিৎ এর কূলপুরোহিতের অপরূপ সুন্দরী বিধবা কন্যা হেমবতী শরীরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করেন ।সেই রাতেই হেমবতী গেলেন নিকটস্থ "রতি তলাও"নামে পুষ্করিণীর শীতল জলে স্নান করে দেহের জ্বালা জুড়াতে । গভীর রাতে নির্জন পুষ্করিণীর পাড়ে  পরণের বস্ত্র খুলে রেখে নগ্ন দেহে নিশ্চিন্তে জলবিহারে মেতে উঠেছিলেন তিনি । কিন্তু পুষ্করিণীর পাড় নির্জন হলে কি হবে ,আকাশে ছিলেন চন্দ্রদেবতা । অপরূপা হেমবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে কামনা তাড়িত চন্দ্রদেব নেমে আসেন সেই নির্জন পূস্করিণীর ধারে এবং হেমবতীকে প্রেম নিবেদন করেন । নিবিড়মিলন সুখে অতিবাহিত হয় রাত্রি । কিন্তু উষার প্রথম লগ্নে রতি তৃপ্ত চন্দ্রদেব যখন ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছেন তখন সম্বিৎ ফিরে পান হেমবতী । ক্ষণিক দেহ সুখের বাসনা তাকে এ কোন পথে নিয়ে এসেছে ! এই মিলনের ফলে তিনি যদি গর্ভবতী হয়ে পড়েন তবে সে লোকলজ্জা তিনি একা বহন করবেন কি করে ।প্রবল আত্মগ্লানি আর বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে হেমবতীর মন । অভিশাপ দিতে উদ্যত হন চন্দ্রদেবকে । চন্দ্রদেব এতটুকু বিচলিত না হয়ে এই বলে হেমবতীকে আস্বস্ত করেন যে তার গর্ভজাত সন্তান হবেন জগৎবিখ্যাত এক পরাক্রমশালী রাজা । সেই সঙ্গে তিনি হেমবতীকে কাশী ছেড়ে কর্ণাবতী নদীতীরে "খজুরবাটিকা"তে গিয়ে সন্তানজন্মের প্রতিক্ষা করতে ।   যথা সময়ে হেমবতীর সন্তান ভুমিষ্ঠ হয় - নাম হয় চন্দ্রবর্মন  । চন্দ্রদেব ধরাধামে এসে আশীর্বাদ করেন নবজাতককে ।  লোকগাথা অনুযায়ী এই চন্দ্রবর্মন ই চন্দ্রবংশীয় চান্দেলা রাজ বংশের আদিপুরুষ ।বস্তুত চান্দেলা রাজবংশের রাজফলক - সিংহের সাথে যুদ্ধরত বালক, চন্দ্রবর্মনেরই শৌর্যের প্রতীক চিহ্ন ।
                       ঝঙ্কার হোটেলের লবিতে লটকান একটি বোর্ডে আঁকা মানচিত্র দেখে জেনে নিয়েছিলাম  খাজুরাহোর মন্দিরগুলি  শহরের পূর্ব ,পশ্চিম ও দক্ষিন  মোটামুটি এই তিনটি অঞ্চলে এক একটি cluster  এ অবস্থিত । সময় সংক্ষেপ করতে অনেকেই  গাড়িভাড়া করে একই দিনে সব কটি অথবা বিশেষ কয়েক টি মন্দির দেখে ফিরে যান ।আমাদের তাড়া ছিলনা ,তাছাড়া খবর নিয়ে জানা গেল পশ্চিমের মন্দিরশ্রেণী হটেল থেকে দেড় বা খুব বেশী হলে দুই কিলোমীটার রাস্তা - অনায়াসে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় ।
               হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে দুকদম এগোলেই পড়ে শ্যাম পোদ্দার চৌক । চৌক বলতে যদি চৌমাথা বোঝায় তবে এ নামকরণে কিছু ভ্রান্তি আছে ।কারণ রাস্তার এই মোড় চারটি রাস্তার সঙ্গমস্থল নয় । আসলে সাতনা থেকে বাসে চেপে যে পথ দিয়ে আমরা এসেছিলাম সেটা সোজা এগিয়ে গেছে পশ্চিমের মন্দির শ্রেণীর দিকে । বাস স্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তাটা ঝঙ্কার হোটেলের সামনে দিয়ে বড় রাস্তার দিকে গেছে সেটার সঙ্গে বড় রাস্তার সংযোগ স্থলটিই হল শ্যাম পোদ্দার চৌক । চৌমাথা হোক না হোক সেই মোড়ের ঠিক মাঝখানে একটা বেদীর ওপরে পাথর খোদাই রত এক শিল্পীর প্রতিকৃতি স্থাপিত আছে । পা দুখানি মুড়ে বসে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পেশল দুই হাতে একাগ্রচিত্তে পাথর খোদাই করে ফুটিয়ে তুলছে অপরূপ স্থাপত্যকলা ।তার এক হাতে ছেনি অন্য হাতে হাতুড়ি।চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ কাজের দিকে । তার মুখে তেরছা ভাবে এসে পড়েছে ভোরের নরম আলো । সে আলোয় উদ্ভাসিত তার মুখ ।মূর্তির নীচে একটি ফলকে লেখা যে সব অগণিত শিল্পী কারিগর তাদের অক্লান্ত শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে খাজুরাহোর এই মন্দিররাজি গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে তাদের স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে এই মূর্তি স্থাপিত । ভালো লাগল এই প্রচেষ্টা । ভারতবর্ষের আর কোথাও কোন মন্দিরে বা স্মৃতি স্তম্ভে শিল্পী কারিগররা এই স্বীকৃতি পেতে দেখিনি । সর্বত্র দেখেছি শুধু রাজরাজড়াদেরই নাম । খাজুরাহো তার ব্যতিক্রম ।
আমি আর জেমস হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম একটা বাজারের কাছে। আমাদের বাঁদিকে একটা বিশাল পুকুর - শিব সাগর তার নাম ।রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে শিবসগরের ইঁট বাঁধান ঘাট । আর তার দূর প্রান্তে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা মন্দিরের চূড়া । 
রাস্তার ডান দিকে অজস্র দোকান পাট,ব্যাঙ্ক হোটেল । সে সব দেখতে দেখতে চলেছি এগিয়ে,হঠাৎ আমাদের গতি রুদ্ধ হল অনুচ্চ একটা পাঁচিলের সামনে । পাঁচিলের দুই দিকে দুটো গেট প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য । এই পাচিলের ওপারে গাড়িঘোড়া ঢুকতে পারবেনা - সামনের পথ কেবল মন্দির দর্শনার্থীদের স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করার জন্য সংরক্ষিত । এই ঘেরাটোপের মধ্যে দেখি জমজমাট বাজার বসে গেছে । কিন্তু আমাদের মন সেদিকে নেই।সামান্য এগিয়েই বাম দিকে মন্দির কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে প্রবেশ করার গেট । টিকিট কেটে রীতিমত সিকিউরিটি চেক করিয়ে তবে প্রাঙ্গনে পা রাখতে পারলাম । সমগ্র প্রাঙ্গনটির মধ্যে ধুমাপান নিষিদ্ধ । তাই আমার পকেটের সিগারেট প্যাকেট ও দেশলাই জমা রাখতে হল প্রহরীর কাছে। মন্দির দেখে বেরোবার সময় ফেরৎ পাব সে গুলি ।
গেট থেকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল সবুজ ঘাসে মোড়া বিশাল মাঠ ,আর তার মাঝে জায়গায় জায়গায় ছোট বড় বহু গাছে - আর সেই গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম মাঠের দূর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মান্দির গুলোকে ।মন্দির তো নয় ,যেন এক একটা  কারুকার্য খচিত রাজপ্রাসাদ!গৈরিকবর্ণের বেলে পাথরের মন্দিরের গায়ে প্রভাতী সূর্যের আলো পড়ে  মনে হচ্ছে যেন পাকা সোনা দিয়ে গড়া ইমারতগুলো ।দুপাশে কেয়ারি করা বাগানের মাঝখান দিয়ে পর্যটকদের হাটাচলার রাস্তা । সেই রাস্তা ধরেই এগিয়ে গেলাম বাঁ দিকে ।মাটি থেকে সাত-আট ফুট মত উঁচু একটা বিশাল চৌকোনা চাতালের ওপরে সোনালি রোদ্দুরে ঝলমল করছে লক্ষণ মন্দিরের চূড়া ।স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম কয়েক মুহুর্তের জন্য । কি বিপুল আয়োজন !অথচ কি অসামান্য সঙ্গতি সেই আয়োজনের সমাহারে । মাটি থেকে নয়দশ ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে অনুচ্চ পাথরের দেওয়াল ঘেরা চাতালে - সেই চাতালের মাঝখানে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মন্দিরটি।
আবিষ্ট ভাব কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (৯৩০-৯৫০) রাজা যশোবর্মনের আমলে তৈরী লক্ষণ মন্দিরের কাছাকাছি ।
মন্দির চাতালের পাশ দিয়ে রাস্তা করা আছে মন্দিরটাকে প্রদক্ষিণ করার জন্য ।চাতালের গায়ে অসংখ্য পাথরের মূর্তি । কোথাও  সৈন্যদলের মহা সমারোহে যুদ্ধ যাত্রার দৃশ্য। একদল পদাতিক সৈ্ন্যদল বীরবিক্রমে চলেছে সমরে ,তাদের সারিতে আছে  অশ্বারোহী যোদ্ধা, আবার সেই সারির পিছনে আছে গজারোহী বাহিনী ।পদাতিক সৈ্ন্যদের কাঁধে শানিত তরবারি । মূর্তি গুলির মধ্যে বিশেষকরে হাতি ঘোড়া প্রভৃতি পশুদের গড়ন এক কথায় অসাধারণ । অন্য একটি প্যানেলে দেখা গেল সৈন্যবাহিনীর অগ্রভাগে একদল লোক ভেরী,বাঁশি,ঢোলক,খঞ্জনী প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে চলেছে। দেখে মনে হতে পারে যে এ কোন যুদ্ধ শেষে বিজয় মিছিল চলেছে ।আবার মাঝে মাঝে নানান নক্সা কাটা প্যানেলও রয়েছে অনেকগুলি ।
       চাতালের চারপাশ পরিক্রমা করতে করতে হঠাত একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতে হল।আমার সামনেই পর পর কয়েকটি প্যানেল জুড়ে বিভিন্ন ভঙ্গীমায় রতিক্রিয়ারত নারী পুরুষের কিছু মূর্তি ।আত্মরতি ,মুখমেহন থেকে শুরু করে অজাচার - কিছুই বাদ নেই সেখানে। ওই প্যানেলগুলর কাছেই অন্য একটি প্যানেলে দেখা মিলল তথাকথিত "69"আসনে সম্ভোগলিপ্ত যূগলের।
নিজেকে ঠকানো সবচাইতে কঠিন।স্বীকার করে নেওয়া ভালো খুব খুঁটিয়ে দেখেও ওই কয়টি প্যানেলের মূর্তি গুলির মধ্যে আমি সৌন্দর্য আবিস্কার করতে পারিনি।তাদের রঙ,texture গড়ণ সবকিছুই অন্যান্য প্যানেলের মূর্তি গুলি সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বালখিল্য বোধ হয়েছে।তবে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে এ মনোভাবের পিছনে আমার ব্যক্তিগত সংস্কার কাজ করেছে কিনা,সেব্যপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত নই।
 
মূল চাতালের চারকোনে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোট মন্দির রয়েছে । তাদের একটির পরিচয় পাওয়া গেল।প্রাথমিক পর্বে এই ছোট মন্দিরটি গড়ুরের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।কিন্তু পরবর্তী কোন এক সময়ে গড়ুরের পরিবর্তে সে মন্দিরে ঠাই পেয়েছেন ব্রাহ্মনি নামে এক দেবী ।

    যদিও স্থাপত্যবিদ্যায় আমার কোন অধিকার নেই,তবু মন্দিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার আনাড়ি চোখ দিয়েই বুঝে নিতে চেষ্টা করলাম মন্দিরের গঠন শৈলী ।
 
daa`nrhiye aamaara aanaarhi chokha diyei bujhe nite cheshhTaa karalaama mandirera gaThanashoilI.chaataalera tala theke aaro saata aaTha phuTa u`nchute mandirer pradhaana prabesha torana.toranera dupaashe duTi bargaakaara thaama – thaamera maathaaya paatharera chhada eba`m taara opare toranera gambujaakRiti churhaa.toranera uparibhaage dudika theke jholaano duTi kumIrera(kumirera cheye bichhera sangei segulira saadRishya beshi) deha Thika toranera maajhaamaajhi ese milita hayechhe anekaTaa makaramukhi baalaara mata.praachIna sthaapatya rItite ekei bodha haya makara toraNa balaa haya.

toranera churhara pichhane apexaakRita u`nchu manDapera churhaa eba`m sabaara pichhane sabachaaite u`nchu churhaaTi garbhgRihera. churhaagulir maapa emana bhaabe nirdhaaraNa karaa Je dUra theke dekhale pratyekaTi churhara shIrshha bindugulike terachhaa bhaabe Taanaa ekaTi kalpita rekhaaya Joga karaa Jaaya.toraNera dui pasha theke dekhaa Jaaya duTi suxma kaarukaarJe kanTakita baarndaa.aamaara anaarhi chokha baaraandaagulira sange raajasthaanera praasaadera jharokhaara mila aachhe bale mane hala.
maandirera gaaye khope khope asa`mkhya mUrti.taara madhye aachhe bibhinna
Jadio sthaapatya bidyaaya aamaara kona adhikaara nei <,> tabu mandirera mukhomukhi

       

Thursday, November 8, 2012

সুবিনয় রায়


তারা বাংলার সৌজন্যে আজ মনে পড়ে গেল আজ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম অগ্রগণ্য শিল্পী সুবিনয় রায় এর বিরানব্বইতম জন্মদিন । তারা বাংলায় আজ সকালের আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন লোকান্তরিত শিল্পীর পুত্র শ্রী সুরঞ্জন রায় । সুরঞ্জনের গায়নে তাঁর পিতার গায়নভঙ্গীর ছাপ চিনে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়না এমনকি মধ্য সপ্তকের ষড়জ স্বরটি যেভাবে একটু চাপা গলায় উচ্চারণ করতেন সুবিনয় রায় সুরঞ্জনের কন্ঠে যেন  তারই অনুরণন শুনলাম এমনকি সুবিনয় রায়ের অতি পরিচিত(ক্ষেত্র বিশেষে বিরক্তিকর ও বটে ) ম্যানারিজম ,থেকে থেকে গলা ঝেড়ে নেওয়া , অবধি নিখুঁত ভাবে আয়ত্ব করে নিয়েছেন সুরঞ্জন রায় । শুধু সুরঞ্জনের গায়নে পাওয়া গেলনা সুবিনয় রায়ের কন্ঠ লাবণ্য এবং সুরের অতলে একটু একটু করে তলিয়ে যাবার সুখানুভুতিটুকু । অবশ্য আজ সকালের আমন্ত্রনে র মত একটি জনপ্রিয় টক - শোতে বিশুদ্ধ সঙ্গীত রস আশা করাটা হয়ত একটু বাড়াবাড়ি ।তাই আমার ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তিজনিত আক্ষেপের কথা থাক আমি বরং ফিরে যাই সুবিনয় রায়ের কথায় ।  
  সুবিনয় রায় কে প্রথম চাক্ষুস দেখেছিলাম এবং সামনে বসে তাঁর গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল জামশেদপুরের টেগোর সোসাইটি পরিচালিত সঙ্গীত শিক্ষায়তনের ক্লাস রুমে । প্রায় প্রতি মাসে একটি রবিবার তিনি টেগোর সোসাইটিতে স্পেশাল ক্লাস নিতেন এবং সেই ক্লাসে শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন আমাদের শিক্ষকরাও । গান তো শেখাতেনই তার সঙ্গে চলত গাননিয়ে নানান আলাপ আলোচনা । স্বীকার করতে লজ্জা নেই অল্প বয়সে সে সব আলোচনায় যোগ দেওয়া তো দূরস্থান তার অনেক কথাই বুঝতামনা । কিছুটা হয়তো বুঝেছি উত্তর কালে সঙ্গীত চর্চার মধ্য দিয়ে ।
আলাপ আলোচনার মধ্যে ঢুকতে না পারলেও গানটা শ্রবণ মাধ্যমে প্রাণে অবশ্যই ঢুকত । মনে আছে প্রথম যে দিন আমি ওই স্পেশাল ক্লাসে যোগ দেবার যোগ্যতা অর্জন করে দুরুদুরু বক্ষে বয়জ্যেষ্ঠদের মাঝে এককোনে গিয়ে বসেছিলাম সেদিন সুবিনয় রায় আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত গানের তালিকা চেয়ে নিয়ে শেখাতে শুরু করলেন আমার না বলা বাণীর ঘনযামিনীর মাঝে , তোমার ভাবনা তারার মত বাজে গানটি।
বালখিল্য ঔদ্ধত্বে নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছিল গানের তালিকায় থাকা কঠিন কঠিন গানগুলি ছেড়ে সুবিনয় রায় হঠাৎ এই সহজ কীর্তনাঙ্গ সুরের গানটিকে  বেছে নিলেন কেন । এখন মনে হয় গানটির আপাত সরল সুরের মধ্য দিয়ে গীতি কবিতার সাবলাইম রূপের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হয় তো তাঁর লক্ষ্য ছিল সেদিন। একালের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের গানে এই বস্তুটির অভাব ব্যক্তিগত ভাবে পীড়িত করে আমাকে । শিল্পী সুবিনয় রায়ের কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে বারে বারে আমার ওই সাবলাইম রূপের কথাই মনে হয়েছে ।আমি নিজেও আমার গানের পরিবেশনায় চেষ্টা করি ওই সাবলাইম রূপটিকে স্পর্শ করতে । বেতারে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর কন্ঠে শুনেছিলাম আমার পরাণ লয়ে  কি খেলা খেলাবে ওগো পরাণ প্রিয়। এ গান  আর কারো কন্ঠে অমন করে জাগিয়ে তোলেনি আমার চেতনাকে । বাড়াবাড়ি করার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে আপত্তি নেই আমার তবু এ গান আর কারো গলায় শুনতে রাজি নই আমি ।   
সুবিনয় রায়ের প্রতি মুগ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানবিশী বেলায় একটু সন্ত্রস্ত হয়েও থাকতাম ।কারণ গান শেখাতে শেখাতে মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটত তাঁর । গানের কোথাও সুরটি যথাযোগ্য ওজনে লাগলনা বা সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজটি পরিপাটি ভাবে সম্পাদিত হলনা এ জিনিষ সহ্য করতে পারতেননা । আর ক্লাসের কনিষ্ঠতম সদস্য হওয়ার অপরাধে রসভঙ্গের যাবতীয় দায় এসে পড়ত আমারই ঘাড়ে । এটাই আমার কাছে একটা বড় পীড়ার কারণ ছিল সে কালে ।
মনে পড়ে একবার এক সুন্দরী ছাত্রী  গানের খাতার বদলে  তিনখন্ড গীতবিতান নিয়ে ক্লাস করতে এসেছিল বলে সুবিনয় রায় কঠিন স্বরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন –“কলকাতায় কোন ছাত্র বা ছাত্রী খাতা না নিয়ে ক্লাসে এলে তাকে বলি বাইরে বাজার থেকে একটা খাতা কিনে নিয়ে তবে  ক্লাসে আসতে । এখানে দোকান বাজার কাছে নেই বলে সে কথাটা বলতে পারছিনা । পরের দিন থেকে খাতা না নিয়ে ক্লাসে আসবেননা সুকন্ঠী  এবং সুন্দরী মেয়েটির অবস্থা দেখে সেদিন দেখার মত হয়েছিল । মেয়েটি সুবিনয় রায়ের বিশেষ অনুরাগী তথা জামশেদপুরের এক প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের আত্মীয়া বলেই বোধ হয় অল্পে রক্ষা পেয়েছিলেন সেদিন ।
 গান ছাড়া সুবিনয় রায়ের আর দুটি জিনিষ আমাকে আকর্ষণ করত ,তার প্রথমটি হল তাঁর বেশভূষা । পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবী পরেই তাঁকে বেশীরভাগ সময় দেখতাম ।সে সাজের মধ্যদিয়ে একধরণের আভিজাত্য প্রকাশ পেত ।আবার পুরোদস্তুর ড্রেস স্যুটেও দেখেছি খুব পরিপাটি ভাবে সাজতেন ।এমনি পোষাক সচেতন মানুষ আর এক জনকে দেখেছি আমি ,তিনি বিমলভূষন । 
 দ্বিতীয় যে জিনিষটি আমাকে আকর্ষণ  করত তা হল তাঁর বাচনভঙ্গী ।এই বাচনভঙ্গী সম্ভবত কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মপরিবার সুত্রে পাওয়া । সে সময়ে বাজারে ছিল চিনির আকাল। সাধারণ লোকে গুড় দিয়ে চা খাওয়া অভ্যাস করতে বাধ্য হয়েছিল চিনি দেওয়া চায়ের খোঁজ পড়ত শুধু মাত্র অতিথী অভ্যাগতদের আপ্যায়নের বেলায় । সেই চিনি দেওয়া স্পেশাল চা বরাদ্দ ছিল সুবিনয় রায়ের জন্য । যে লোকটির ওপরে চা দেওয়ার ভার ছিল সে একবার অন্যমনস্ক হয়ে সবার সঙ্গে সুবিনয় রায়কেও গুড়ের চা ই দিয়ে গেছে । আমরা দেখলাম কথার ফাঁকে সুবিনয় রায় চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলেন এবং তার পর আর সে কাপ হাতে তুললেননা । জনৈক কর্মকর্তার চোখে ব্যপারটা পড়া মাত্রই গোলমালটি অনুমান করে নিয়ে অপ্রস্তুত কন্ঠে সুবিনয় রায় কে বলেন ইসস ... বোধ হয় ভুল করে আপনাকেও গুড়ের চা ই দিয়ে গেছে । দেখি আর এক কাপ আপনার জন্য পাঠিয়ে দিতে বলি। সুবিনয় রায় তাঁর পরিচিত বাচনভঙ্গীতে বললেন ...আরে না না ব্যস্ত হবেননা ।গুড়ের চা খেতে আমার বেশ ভাল ই লাগে । বলার ধরণের কারণে এই বাক্যটি নিয়ে আমরা হাসাহাসিও করেছি বহুদিন ।

Tuesday, November 6, 2012

দার্জিলিং এ - স্মৃতির সরণী বেয়ে



প্রায় চুয়াল্লিশ বছর পরে আবার চলেছি দার্জিলিং এ । কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে একদল সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে দলবেঁধে বেড়াতে গিয়েছিলাম শৈল শহর দার্জিলিং এ । অসম্ভব ভাল লেগেছিল পাহাড়ি শহরটাকে কিছুটা জায়গাটার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে আর কিছুটা সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গ গুনে । এবারে চলেছি একেবারে একা । না একেবারে একা বলাটা বোধ হয় ঠিক হবেনা ।আমার সঙ্গে আছে চুয়াল্লিশ বছর আগেকার ভাললাগার স্মৃতি ।
 বাসটা শিলিগুড়ির সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছতে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার । নির্ভাবনায় আরামপ্রদ ভ্রমন নিশ্চিত  করতে যাত্রার তিনমাস আগেই দার্জিলিং মেলে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যাতায়াতের টিকিট কেটে নিয়েছিলাম।কিন্তু বিধিবাম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক আর কয়েকটি রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে রেখে ভারতীয় জনতা পার্টি ও বামপন্থী দলগুলি একযোগে ২৮শে ফেবরুয়ারি দিনটিতে দেশ জুড়ে হরতালের ডাক দিয়ে বসলেন । অগত্যা শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ অনুযায়ী আমার ২৮শে ফেবরুয়ারি তারিখের দার্জিলিং মেলের টিকিট বাতিল করে পরের দিন অর্থাৎ ২৯শে ফেবরুয়ারি ধর্মতলা থেকে বাসেই রওয়ানা হলাম। ধর্মতলা থেকে শিলিগুড়ির সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড অবধি এই তেরচোদ্দ ঘন্টার যাত্রাপথ যে এতটা দুর্বিষহ হতে পারে তা আমার ধারণা ছিলনা । একে তো রাত্রির অন্ধকারে জানালার বাইরে কিছুই দেখা যায়না বলে মনটা খাঁচায় আবদ্ধ জীবের মত ছটফট করতে থাকে বিকল্প হিসেবে চিৎপটাং শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব , বাসে তার উপায় নেই ব্যাকরেস্টটাকে যতই পিছনে হেলাও না কেন,কোনভাবেই তা বিছানার আরাম দিতে পারেনা । বাড়তি উপদ্রব দেখা দিল বারাসত পেরিয়ে যাবার পর ।খানাখন্দে ভরা  ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় শুরু হল বাসের তুর্কী নাচন । ঝাকুনির চোটে শরীরের হাড়গোড়গুলি রাস্তায় যে খুলে পড়ে যায়নি তাই যথেষ্ঠ । এটাই নাকি কলকাতার সঙ্গে সমগ্র উত্তরবঙ্গের সংযোগ রক্ষাকারি জাতীয় সড়ক !   
 বাসস্ট্যান্ডে পা রাখা মাত্র আমায় ছেঁকে ধরল ট্যাক্সিওয়ালাদের ছোটখাটো একটি জনতা।দার্জিলিং   মিরিক গ্যাংটক কালিম্পং  যে চুলোয় আমি যেতে চাই ,সেখানেই তারা আমায় পৌঁছে দেবে ,পছন্দসই হোটেল ও জোগাড় করে দেবে ।অবশ্য দার্জিলিং এ থাকার জন্য হোটেল আমি কলকাতায় বসেই বুক করে এসেছি শোনামাত্র গাড়িওয়ালাদের ভীড় পাতলা হয়ে গেল তারা ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল পছন্দ মাফিক অন্য যাত্রীর সন্ধানে। পড়ে রইল শুধু রোগা পটকা একটা লোক । সে যাবে দার্জিলিং এ ।তার টাটা সুমোয় আর একটা সীটই খালি আছে । আমি সওয়ার হয়ে বসা মাত্র সে গাড়ি ছেড়ে দেবে ভাড়া লাগবে একশো পঁচিশ টাকা।
আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলার আগেই দেখি সে কখন আমার সুটকেসটাকে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে এবং হনহনিয়ে হাঁটা দিয়েছে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টাটা সুমো গাড়ির দিকে । লোকটির এই তৎপরতা আমার ভাল লাগলনা । দিনকাল ভাল নয় লোকটা যদি এখন আমার সুটকেস নিয়ে উধাও হয়ে যায় তা হলে একমাত্র চিৎকার করে লোক জড়ো করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবনা আমি । তবে তেমন অঘটন কিছু ঘটলনা । আমি তার টাটাসুমো গাড়ির কাছে পৌছতে পৌছতে লোকটি আমার সুটকেসটিকে চালান করেদিয়েছে গাড়ির মাথায় । এমন কি বেড়াতে এসেছি বলে সে সামনের সীটে বসে থাকা এক আরোহিকে বিশেষ অনুরোধ করে পেছনের সীটে পাঠিয়ে দিয়ে সামনের সীটে জানালার ধারের আসনটি আমার জন্য খালি করিয়ে দিল । আসনচ্যুত সহযাত্রীটি ও দেখলাম বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল ড্রাইভারের অনুরোধ ! কোন অজানা অচেনা লোকের জন্য এমন বদান্যতা চটকরে চোখে পড়েনা আজকাল।তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি উঠে বসলাম ড্রাইভারেরা পাশের আসনে ।




গাড়ি ছুটে চলল এবার ব্যস্ত শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে হিলকার্ট রোড ধরে । সমতল পথেই গাড়ি চলেছে দ্রুত গতিতে পিছনে সরে সরে যাচ্ছে দোকানপাট ছোট ছোট ঝুপড়ি মত চায়ের ঠেক,সাইকেল সারাইএর দোকান । বেশ খানিকটা দূর চলার পর এখন আর লোকালয় চোখে পড়ছেনা । তাদের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে দু একটা ছোটো ছোটো চা বাগান সে সব ছাড়িয়ে আর দূরে দিগন্তে আবছা দেখা যাচ্ছে নীলকান্ত পাহাড়ের সারি ।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব ওই গিরিশ্রেণীর নিচে ।সেখান থেকে শুরু হবে পাহাড়ের গা বেয়ে চড়াই এর পথ ।সে পথের বাঁকে বাঁকে পাহাড় তার রূপের ডালি পরতে পরতে মেলে ধরবে আমার চোখের সামনে । গাড়ির যাত্রীদের মধ্যে এক আমি ছাড়া বাকি নজন ই কোন না কোন সরকারি দপ্তরের কর্মী , দার্জিলিং এ চলেছেন দপ্তরের কাজে । তারা মেতে রইলেন নিজেদের অফিসের গল্পে ।
আমি ভাবছিলাম পুরনো দিনের কথা । ছাত্রজীবনে কলেজের ব্যবস্থাপনায় যখন এ তল্লাটে বেড়াতে এসেছিলাম তখন শিলিগুড়ি থেকে আদ্দিকালের ল্যান্ডরোভার গাড়িতে নিজেদের বাক্স বিছানার সঙ্গে গাদাগাদি করে বসে অতি কষ্টে পৌঁছেছিলাম দার্জিলিং এ । মালপত্র সহ সাত আট জন ছেলেমেয়ের বসার পক্ষে গাড়ির ভিতরে যথেষ্ট জায়গা ছিলনা।তাই যাত্রাটা খুব সুখকর হয়েছিল তা বলতে পারিনা ।তার ওপরে পাহাড়ে ওঠার সময় পাকদন্ডী পথে আমাদের অনেকের ই গা-বমি ভাব লেগেছিল ।গাড়ির নেপালি চালক আমাদের আস্বস্ত করেছিল এই বলে যে সমতলের মানুষদের অনেকেরই পাহাড়ে ওঠার সময় এ ধরনের শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয় । ওতে চিন্তার কোন কারণ নেই । অবশ্য ওই বয়েসে এমন অনেক ছোটো খাটো অসুবিধে অনায়াসে উপেক্ষা করা যায় । ওই চাপাচাপির মধ্যেই গাড়ির ছোট্ট জানালা বা মালপত্রের ফাঁক ফোকর দিয়ে হিলকার্ট রোডের দুপাশের প্রাকৃতিক শোভা । নিবিড় অরণ্যময় পাহাড়ি প্রকৃতির  বিশালত্ব আর অতলান্তিক নিস্তব্ধতা দিয়ে আমার সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল । এবারে দেখছি সবই উল্টো । পাকদণ্ডী পথের চারপাশে সবকিছুই কেমন যেন বিবর্ণ ধুসর ! বেশ অনেকটা চড়াই পথ পার হবার পর ও সব কিছুই কেমন যেন শ্রীহীন লাগছে ।পথের কোন বাঁকেই কোন চমক নেই ।হয়ত সত্যি ছিলনা কোনকালেই । সবটাই ছিল আমার নবীন চোখের মায়া আবরণ !  বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের ওপর থেকে সরে গেছে প্রথম যৌবনের মোহাঞ্জন ভোঁতা হয়ে গেছে অন্তরের বিষ্ময়বোধ ।তাই হয় তো এখন আর সহজে মন ভোলেনা । আবার সেই সঙ্গে আরো একটা জিনিষ ঘটে গেছে এই চুয়াল্লিশ বছরের ব্যবধানে । দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাহাড়েও বেড়েছে জনসংখ্যা ।সেই বাড়তি জনসঙ্খ্যার চাপে দিনে দিনে একটু একটু করে ক্রমশ পিছু হটেছে প্রকৃতি । রাস্তার ধারে ধারে এত দোকান পাট ,এত ঘরবাড়ি তো চোখে পড়েনি আগের বার ।সেবারে দেখেছিলাম রাস্তার এক পাশে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল আর অপর দিকে গভীর খাদ । এতটাই গভীর সে খাদ যে সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুরুদুরু করে ওঠে বুক । এবারে তাকে আর ততটা ভয়ঙ্কর লাগছেনা তো ! খাদের কিনার ঘেঁষে এক একটি চুলের কাঁটার মত বাঁক নেবার সময়ে যে শিহরণ অনুভব করেছিলাম আগের বার সে শিহরণ জাগলনা একবারের তরেও ।
  কখন যে কার্সিয়াং পার হয়ে গেছি টের পাইনি । চেনা পাহাড়ী প্রকৃতির দেখা পেলাম ঘুম এর কাছাকাছি পৌঁছে । রাস্তার বাঁদিকে দেখা গেল ক্রিপ্টোমেরিয়া গাছের ঝাঁক । বিশাল লম্বা লম্বা গাছগুলো যেন আগন্তুকদের গার্ড অফ অনার জানানর জন্য পথের ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে টানটান হয়ে । গাছগুলোর ফাঁক গলে কুণ্ডলী পাকানো  ধোঁয়ার মত সাদা মেঘের দল গজেন্দ্র গমনে বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চার পাশে । ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আসছে চারপাশ । হাল্কা শীতের আমেজ টের পাওয়া গেল এবারে । সহযাত্রীদের দেখলাম নিজের নিজের ব্যাগ থেকে গরম জামা বের করে গায়ে চড়িয়ে নিচ্ছেন ।

বাস থেকে নামার আগেই সুটকেস থেকে আমি গরম জ্যাকেট বার করে হাতে রেখেছিলাম , এতক্ষণ সেটা আমার কোলের অপরে রাখা ছিল ।আমিও সেটা গায়ে চড়িয়ে জিপটা টেনে দিলাম একেবারে গলা অবধি।এই রকম প্রাকৃতিক পরিবেশই তো এই পাহাড়ী এলাকায় প্রত্যাশা করেছিলাম । কিন্তু আরো একটু এগোতে না এগোতেই ক্রিপ্টমেরিয়া গাছেরা অদৃশ্য হয়ে গেল । তার বদলে দেখা দিল অজস্র দোকান পাটে ভরা একটা বাজার । অনেক লোকের ভীড় সেখানে । ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ইউনিফর্ম পরা নানা বয়সী ছেলে মেয়ে পিঠে স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে হৈ হৈ করতে করতে স্কুলে চলেছে ।
সমুদ্র তল থেকে প্রায় সাড়ে সাতহাজার ফুট উচ্চতায় উঠে পৌঁছলাম ঘুম । সামনেই ঘুম রেলস্টেশন । দূর থেকে মেঘের আস্বচ্ছ ওড়নায় ঢাকা জরাজীর্ণ স্টেশনটা হানাবাড়ির মত দেখতে লাগল । লোকজন বিশেষ নেই শুধু একটা ইঞ্জিন স্টেশনের টিনের ছাউনি থেকে গলা বাড়িয়ে যেন হিলকার্ট রোডে লোক চলাচল দেখছে  ঘর বন্দী চঞ্চল বালকের্‌ মত । এটাই নাকি পৃথিবীর সব চাইতে উঁচুতে অবস্থিত রেলস্টেশন । প্রথমবার যখন এই জায়গায় এসেছিলাম তখন জায়গাটায় এত ঘরবাড়ি ছিলনা । হাড়কাঁপান ঠান্ডা আর নিঝুম নীরবতার জন্যে জায়গাটাকে একটা হিমশীতল মৃত্যু পূরীর মত মনে হয়েছিল । যেন কোন এক মায়াবী দানবের মায়াপ্রভাবে গোটা জনপদটা গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে আছে । জায়গাটার নামের সঙ্গে তার চরিত্রের এক অদ্ভুত মিল যেন খুঁজে পেয়েছিলাম।  
ঘুম রেল স্টেশন ছাড়িয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে যাবার পর দেখি ছোট্ট এই টুকু একটা ইঞ্জিন তার চোঙাদিয়ে ভুস ভুস করে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ,আর থেকে থেকে হুইসল বাজাতে বাজাতে তিনটে ছোটো ছোটো কামরাকে টেনে নিয়ে হেলতে দুলতে চলেছে ঘুম স্টেশনের দিকে । ট্রেনের চলন দেখে আমার বাচ্ছাদের খেলনার কথাই মনে পড়েগেল । ঠিক যেন এক সার দম দেওয়া খেলনা হাঁস দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে । এককালে দার্জিলিং এর যাত্রীদের নিয়ে সকাল নটায় নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রওয়ানা হয়ে বিকেল চারটে নাগাদ দার্জিলিং এ পৌঁছত । দূরত্বের তুলনায় সাতঘন্টা সময় অবিশ্বাস্য রকমের বেশি । একালের টুরিস্টরা পথে আর অতটা সময় অপচয় করতে রাজি নয় ।তারা শিলিগুড়ি অথবা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আমার মত ট্যাক্সি অথবা বাসে চেপে তিন-সাড়ে তিন ঘন্টায় দার্জিলিং পৌঁছে যায় । কাজেই পর্যাপ্ত যাত্রীর অভাবে আজকাল নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং অবধি থেকে টয় ট্রেন আর চলেনা । তবে যুক্তি যাই বলুক , সময় যতই লাগুক আমি কিন্তু সূযোগ পেলে আজও ওই টয় ট্রেনেই যাওয়াটাকে অগ্রাধিকার দিতাম। কারণ ধীরে ধীরে একটু একটু করে পাহাড়ে ওঠার ফাঁকে অনেকটা সময় কাটাতে পারতাম আরণ্যক প্রকৃতির সঙ্গে ।
প্রথম  যে বার কলেজ ছাত্র হিসেবে এসেছিলাম তার সাত-আঠ মাস আগে এই পাহাড়ে নেমেছিল বিধ্বংসি ধ্বস ব্যপক খয়ক্ষতি হয়েছিল সেবারের প্রাকৃতিক দুর্যোগে । লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল জনজীবন রাস্তাঘাট ।দার্জিলিং এ যাবারও পথে প্রকৃতির সেই ধ্বংসলীলার কিছু কিছু নিদর্শন চোখে পড়েছিল আমাদের । যে টুকু দেখেছিলাম তাতেই শিউরে উঠেছিলাম প্রকৃতির উন্মত্ততার নমুনা দেখে । বাতাসিয়া লুপের কাছে একটি জায়গায় দেখেছিলাম পাহাড়ের ওপর থেকে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসা বোল্ডারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন রেল লাইন স্থানচ্যুত হয়ে ঝুলছে পাশের খাদে ! দুর্যোগ কেটে যাবার সাত কি আট মাস পরে মাটির চাঙ্গড় ,পাথরের বোল্ডার ইত্যাদি পরিস্কার করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা গেলেও বিদ্ধস্ত রেল পরিসেবা তখনও সারাই করে ব্যবহারোপযোগি করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি । কাজেই সেবারে আমাদের সামনে কোন সুযোগ ই ছিলোনা ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং হিমালয়ান রেল পথের ছোট গাড়িতে চড়ার ।খুব আফসোস হয়েছিল ।কিন্তু আমাদের সেই  উনিশ কুড়ি বছর বয়সী মন ছিল বহতা নদীর মত সজীব সচল ।          


পরে আবার কোনদিন যখন এখানে আসব তখন এ খেদ মিটিয়ে নেব এই ভাবনাটা মনে কোন অপ্রাপ্তির বেদনাকে বাসা বাধতে দেয়নি ।  এ যাত্রায় হয়ত সেই অপূর্ণ সাধ মিটিয়ে নিতে পারব । আমার সহযাত্রীদের কথপোকথন থেকে জানতে পেরেছি যে প্রাতি দিন দু জোড়া ট্রেন টুরিস্টদের মনরঞ্জনের জন্য দার্জিলিং ও কার্শিয়াং এর মধ্যে চলাচল করে । অনেকেই সেই জয় রাইডে চড়ে দার্জিলিং থেকে গিয়ে কার্শিয়াং বেড়িয়ে আসেন । তবে আমার মনে এ ব্যপারে কোন উৎসাহ জাগলনা ।পথের অবস্থাটা তো দেখতেই পেলাম ।
ঘুম থেকে দার্জিলিং প্রায় একহাজার ফুট নিচে ।দূরত্বের হিসেবে সাত কি আট কিলোমীটারের মত হবে ।সেই পথটুকু অতিক্রম করতে খুব একটা সময় লাগলনা । ঢালু পথে গড়াতে গড়াতে অচিরেই পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং এর উপকন্ঠে । দার্জিলিং রেল স্টেশন পার হয়ে এইচ ডি লামা রোড ধরে ট্যাক্সি বাজারের মধ্যে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল । ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে নিজের সুটকেসের মালিকানা ফিরে পাবার পর পরই যে চিন্তাটা মাথায় জাগল তা হল মহাকাল নামক সরাইখানাটি ঠিক কোথায় এবং সেখানে পৌঁছনর পথ কে বাতলে দেবে আমায় ।
একটা বন্ধ দোকানের সামনে এসে ট্যাক্সিটা থেমেছিল । সেই দোকানের বন্ধ শাটারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সিড়িঙ্গে মার্কা একটা লোক । সামনে তাকে দেখে তার কাছেই প্রশ্নটা রাখলাম ।লোকটি সামনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জানাল যে ওই রাস্তাদিয়ে খানিকটা গিয়েই বাঁহাতে ঘুরলে এই রাস্তার ওপরে অবস্থিত রবার্টসন রোড সেই রাস্তার ওপরেই মহাকাল হোটেল । সে ভাবে যেতে গেলে একটু হাঁটতে হবে –“ তার চেয়ে ভাল হবে বাবু যদি একটা কুলি করে নেন ,সে বমাল আপনাকে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেবে
কথাটা আমার মনে ধরল । কিন্তু কুলি পাই কোথায় ? সেই সিড়িঙ্গে মার্কা লোকটি সে সমস্যার সমাধান ও বাৎলে দিল । সেইই কুলি তথা পথপ্রদর্শক হয়ে আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে রাজি । কুলিভাড়া লাগবে পঞ্চাশ টাকা ।  আমার লগেজ বলতে ছিল হাল্কা একটি মাত্র চাকা লাগান সুটকেস।সেই মাল বওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা !! কিন্তু দরদস্তুর করে আমি জীবনে কোনদিনই জিততে পারিনি কাজেই এ ক্ষেত্রে দরদস্তুর করতে যাওয়ার কোন মানে হয়না । রাজি হয়ে গেলাম লোকটির কথায় । লোকটি সঙ্গে সঙ্গে কোমরে জড়ান গামছা জাতীয় একটা কাপড় খুলে নিয়ে তাই দিয়ে সুটকেসটাকে বেঁধে পিঠের ওপরে ঝুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনের একটি সিঁড়ির দিকে । খাড়া সিঁড়ি দিয়ে যে দ্রুততার সঙ্গে লোকটি তরতরিয়ে উঠেই চলেছে ধাপের পর ধাপ ,আমার সাধ্য কি তার সঙ্গে পাল্লা দিই । অগত্যা পিছন থেকে কাতর কন্ঠে মিনতি জানাই লোকটি যেন তার চলার গতি একটু কম করে ।
আমার অনুরোধে লোকটি তার গতি কমালো বটে কিন্তু মুখ না ঘুরিয়েই কিছুটা তিরস্কারের স্বরেই বলল এটুকূ চড়াই পথ চলতেই  ক্লান্ত হয়ে পড়লে দার্জিলিং এ বেড়াবেন কি করে ? এখানে তো প্রতিপদে চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে চলতে হবে ।
লোকটির কথায় আমার আত্মাভিমানে ঘা লাগলেও পরিস্থিতির বিচারে নীরবে খোঁচাটুকু তখনকার মত হজম করে নিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে লোকটিকে  অনুসরণ করে চললাম সিঁড়ি ভেঙে।তবে কপালগুণে একেবারে বেদম হয়ে পড়ার আগেই খানদেড়েক খাড়া সিঁড়ি ভেঙে ,কিছুটা গলিপথ পার হয়ে পৌঁছে গেলাম অভীষ্ট গন্তব্যে । বাইরে থেকে রবার্টসন রোডে মহাকাল হোটেলের চেহারা দেখে একটু দমে গেলাম । অত্যন্ত শ্রীহীন ভাঙাচোরা একটা দোতলা বাড়ির একতলায় রিসেপশন , ডাইনিং হল আর কিচেন । লম্বাটে বাড়িটার একপাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা এমন ভাবে বানানো ,যে হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন একটা মই দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা আছে । কিন্তু অপছন্দ হলেও এখন আর কিছু করার নেই । কলকাতায়


ট্র্যাভেলিং এজেন্টের মাধ্যমে বুক করেছিলাম হোটেল। যে কয়দিন এখানে থাকব তার ভাড়া বাবদ দেয় পুরো টাকাটাই মিটিয়ে দেওয়া আছে।অতয়েব এখন আর পরিবর্তনের উপায় নেই । চেক ইন পর্ব সেরে দোতলায় আমার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটা অবশ্য মন্দ নয় । গোটা ঘরের মেঝেতে পাতা বেশ পুরু লাল কার্পেট ।পরিস্কার বাথরুম ,ধবধবে সাদা নরম গদিওয়ালা বিছানা আর শীতের কামড় থেকে রক্ষা পাবার জন্য একজোড়া ভারি সুন্দর দেখতে নরম তুলতুলে পশমের কম্বল ছাড়া আর কিই বা চাইবার থাকে চলতি পথের ধারের সরাইখানায় ! শুধু একটাই খুঁত খুঁতুনি রয়ে গেল ।ঘরে একটি মাত্র ছোট্ট জানলা ,তাও আবার সে জানালা দিয়ে দৃষ্টি ছাড়া পায়না বেশিদূর ,বাঁধা পড়ে যায় হোটেলের ঠিক পিছনের লাগোয়া বাড়িটার টিনের চালে । ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েও নিস্তার নেই । সরু রাস্তাটার অপর পারে সারবেঁধে একগাদা বাড়ি খাড়া দাঁড়িয়ে আকাশটাকে আড়াল করে রেখেছে । আকাশাটাকে এখানে যেন এরা একেবারে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে । মনে আছে এর আগেরবার আমরা  সকালে ঘুমচোখ খুলেই বিছানায় শুয়েই কাচের জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম নীল আকাশের পটে হাল্কা সোনালি রঙে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য । অপার্থিব সে দৃশ্য দেখতে পাওয়ার আনন্দ সারা জীবনে ভোলার নয় । বুঝলাম এযাত্রায় সে সুখ আমার কপালে লেখা নেই । 


                                                                          দুই
হোটেলের ঠিক সামনেটায় অপ্রসস্ত যে টুকু খোলা জায়গা আছে সেটুকুও দখল করে নিয়েছে একগাদা ঝকমকে হাল আমলের ছোট বড় নানান গাড়ির ভীড় । বোঝাই যায় গাড়িগুলি ভাড়ায় খাটে বেড়াতে আসা টুরিষ্টদের বেড়াতে নিয়ে যায় পাহাড়ে দর্শনীয় জায়গা গুলিতে । হোটেল ও নিশ্চই ভাড়ার একটা হিস্যা পায় আর সেই জন্যেই হোটেলের আবাসিকদের যাতায়াতের অসুবিধা হওয়া সত্বেও হোটেলের প্রবেশ দ্বারের সামনে জায়গাটাকে অমনভাবে গাড়ি পার্কিং এর জন্য ব্যবহার করতে দেয় । দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে । হোটেলের সামনে রাখা গাড়ির অরণ্য ভেদ করে ডান হাতে কিছুদূর হাঁটতেই একটা তেমাথার মোড়ে এসে পড়লাম ।রাস্তাটা এখানে ইংরেজি “Y”এর আকৃতি নিয়েছে ।ওয়াই এর একটা বাহু হল রবার্টসন রোড  এবং অন্য বাহুটি হল গান্ধী রোডের একাংশ ,যা ম্যালের দিকে চলে গেছে । আর লেজের দিকটা চলেগেছে জলাপাহাড়ের দিকে ।এই তেমাথাতেই আবার একধাপ নীচে থেকে নেহেরু রোড উঠে এসে যোগ দিয়েছে ।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রাস্তাগুলোকে চিনে নেবার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তার নিচের ধাপে নেহেরু রোডের ওপরে অবস্থিত একটা পাথরের ব্লক গেঁথে তৈরি একটা পুরনো গির্জার ঘড়িওয়ালা চুড়াটা গান্ধী রোডের থেকে কিছুটা ওপরে এসে শেষ হয়েছে । হটাৎ দেখলে মনে হতে পারে নিচের রাস্তার গির্জাটা যেন জিরাফের মত লম্বা গলাটাকে বাড়িয়ে উচ্চতর তলের গান্ধী রোডের ওপরে নজর রাখছে ।
ম্যালের দিকে না গিয়ে আমি উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম গান্ধী রোড বরাবর ।এর আগের বার কলেজের তরফ থেকে হিমালয়ান গ্লোরি নামে যে হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেই হোটেলটি ছিল এই গান্ধী রোডের ওপরে অবস্থিত । হোটেলটার কথা মনে পড়তেই যেন মন কেমন করে উঠল তার জন্য । ইচ্ছে হোল একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি হোটেলটার কি হাল হয়েছে এতদিনে । অসম্ভবের স্বপ্নে মশগুল মন বলে উঠল... হয়ত গিয়ে দেখতে পাবে বন্ধুরা হোটেলে ঢোকার মুখে সিঁড়ির ওপরে বসে গুলতানি করছে এখনও । হয়ত তাদের কেউ তোমায় দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠবে এইইইইই কি পাগলের মত একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস ।আয় আমাদের সঙ্গে যোগ দে । কিন্তু হায় ! কোথায় সে হোটেল ! গান্ধী রোডের প্রায় শেষ মাথা অবধি হেঁটেও তাকে খুঁজে পেলামনা । বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে আসতে গিয়ে একটা দোকানের সামনে  একজন বয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখে মনে হল এই লোকটিই হয়ত আমায় বলতে পারবে পুরনো হোটেলটা আদৌ টিকে আছে না উঠে গেছে ।
আমার অনুমানে ভুল হয়নি । আমার প্রশ্ন শুনে লোকটি জানাল হোটেল টা এখনও চালুই আছে। তবে সেতো এ রাস্তায় নয় ।গান্ধী রোডের ঠিক ওপর দিয়ে যে রাস্তাটা আছে হিমালয়ান গ্লোরি হোটেল সেই রাস্তায়। সে মোকামে পৌঁছনর উপায় ও বাৎলে দিল সেইই । যে দিক থেকে এসেছি সেই দিকেই সামান্য কিছুটা পিছিয়ে গেলে রাস্তার ডানহাতে একটা পানদোকান পড়বে ।সেই পানদোকানের পিছনে গলিটার মুখ ।সেই গলিতেই হিমালয়ান গ্লোরি হোটেল । স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ল বটে যে আগেরবার আমরা গান্ধী রোডে ল্যান্ডরোভার গাড়ি থেকে নেমে নিজের মালপত্র কাঁধে করে একটা স্লোপ বেয়ে হোটেলের মূল প্রবেশ দ্বার অবধি । এবার আর রাস্তাটাকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলনা । যদিও এই আবর্জনায় ভরা কাঁচা রাস্তাটাই যে সেকালের সেই স্লোপ কিনা তা নিশ্চিত করে কে বলবে আমায় মনের মধ্যে খুঁতখুঁতুনি নিয়েই উঠতে লাগলাম সেই রাস্তা ধরে ।
তাই চারি দিকে চায় ,মন কেঁদে গায় এ নহে , এ নহে ,নয় গো ...

হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল হোটেলটায় ঠিক ঢোকার মুখেই কয়েকধাপ সিঁড়ি ছিল ।যে কদিন আমরা দার্জিলিং এ ছিলাম তার প্রায় অধিকাংশ দিনই দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা অনেকেই  এসে বসতাম সেই সিঁড়ির ধাপে । রোদ পোহানর সঙ্গে সঙ্গে চলত দেদার আড্ডা ,পরস্পরের পা টানাটানি ।মেয়েরাও পিছিয়ে ছিলনা,তারাও এসে যোগ দিত সেই দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় । আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যেত সামনের গান্ধী রোডে রঙ বেরঙের পোষাক পরা স্থানীয় নারী পুরুষের অবিরাম আনাগোনা । তাদের চাল চলনে মনেই হতনা যে তারা কোথাও যাবার জন্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে । এক ঝাঁক স্থানীয় তরুণীকে অলস পায়ে সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে গীতশ্রী তো একদিন বলেই ফেলল এই দ্যাখ , এরা বোধ হয় ফ্যাশন প্যারেডে বেরিয়েছে  সেই কোন কালের কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় নিজের মনেই হেসে উঠলাম ।গীতশ্রী বরাবরই ওই রকম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা খোলামেলা স্বভাবের মেয়ে ছিল । আর ওই আনন্দোচ্ছল স্বভাবের জন্যেই সবাই ওকে খুবই পছন্দ করত । গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের তুলনায় ও ছিল খর্বকায় । বোধহয় সেই জন্যেই কলেজে আমরা ওকে সকলে বেবি বলেই ডাকতাম ।
মনে পড়ে গেল সামনের রাস্তার ওপারে একফালি খোলা জমি ছিল ।সেই খোলা জমিতেই এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের ল্যান্ডরোভার ।পরে ওই জায়গাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল কোথাও বেড়াতে বেরনোর আগে আমাদের সমবেত হবার জায়গা । প্রতিদিন সকালে ওই খোলা জায়গাটাতে সকলে এসে জড়ো হবার পর একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হত । জায়গাটার এক পাশে ছিল  অগুন্তি ধাপওয়ালা একটা সিঁড়ি । ওপরে দাঁড়িয়ে সেই সিঁড়ির নিচের দিকে তাকালে মনে হত সিঁড়িটা যেন একেবারে পাতালে নেমে গেছে ! কল্পনায় যত রঙই চড়াইনা কেন বাস্তবে সিঁড়িটা নেমে গিয়ে শেষ হয়েছে নিচের বাজারে । আমরা বেশ কয়েকবার বাজারে ওঠা নামা করেছি ওই সিঁড়ি দিয়ে । যেমন এবারেও আমাকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে হোটেলে পৌঁছনর জন্য উঠতে হয়েছে ওই রকমই অন্য আর একটি সিঁড়িদিয়ে । সেই খোলা জায়গাটা উধাও হয়ে গেছে কবেই । বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে ঊঠল । পরে অবশ্য হারিয়ে যাওয়া খোলা জায়গাটার পুরনো অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছিলাম সিঁড়িটাকে খুঁজে পাবার পর । 


 অবশেষে স্মৃতির সরণী বেয়ে আমার চলা শেষ হল । আমার সামনে হলদে রঙের এক পুরনো ধাঁচের বাড়ি ।দেখে বোঝা গেল বাড়িটাতে অনেক দিন কেউ বাস করেনা । সামনের বাগানের গোটাটাই আগাছার জঙ্গলে ভরে গেছে ,লোহার গেটে লতিয়ে উঠেছে বুনো লতা গাছ । গেটের দুপাশে ফাটল ধরা ভগ্নপ্রায় ইটের পিলারএর একটিতে মারবেল ফলকে দেখলাম বাঙ্গালী গৃহস্বামীর নাম ও বাড়ির প্রতিষ্ঠার সাল তারিখ খোদাই করা রয়েছে । তারিখটি দেখে বুঝলাম আমরা এখানে ঘুরে যাবার পরে বাড়িটি তৈরী হয়েছে ।হলদে রঙের বাড়িটার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার চোখে পড়ল বাঁদিকে বিশাল লন ওয়ালা ঝাঁ চকচকে একটা রিসোর্টের দিকে । তার গেটের কাছে লাগান সাইনবোর্ডে বড়বড় অক্ষরে নাম লেখা হিমালয়ান রিসোর্ট যে প্রবীন দোকানদার আমাকে এই রাস্তার হদিস দিয়েছিলেন তিনি বোধ হয়  হিমালয়ান গ্লোরি হোটেল বলতে এই হিমালয়ান রিসোর্টের কথাই বলেছিলেন আমায় । হয়তো সেই পুরনো হোটেলটাকে ভেঙে ফেলে তার ওপরে গড়ে উঠেছে এই আধুনিক রিসোর্ট । একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে একেবারে নিশ্চিত হয়ে নিতে মন চাইলনা । নিজের অজান্তেই বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ।আমাদের জীবনের কিছু সোনালি মুহূর্তের কত ছবি ওই ইমারতের তলায় চাপা পড়েগেছে চিরকালের জন্য । ধীর পদে নেমে এলাম নীচের গান্ধী রোডে ।সেখান থেকে ফিরে চললাম তেমাথার মোড়ে । তেমাথার মোড় থেকে যে রাস্তাটা ম্যালের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তাটা ধরে আনমনে হেঁটে যেতে যেতে কানে এল গানের সুর । একটু এগোতেই চোখে পড়ল রাস্তার বাঁ ধারের একটা দোকানের দরজার এক পাশে রাস্তার ওপরে বসে একটি লোক সারেঙ্গির মত একটা যন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছে । কান পাতলাম কিন্তু অনেক চেষ্টা করা সত্বেও গানের কথা গুলি বুঝতে পারলাম না । গানের সুরটাও কেমন যেন ঘুমপাড়ানি গানের মত একঘেয়ে ।বিশেষ ওঠাপড়া নেই সে সুরে পঞ্চম থেকে তার সপ্তকের ষড়জ এই পরিধির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিল গায়কের কন্ঠস্বর । সঙ্গতকারি যন্ত্রটি সারেঙ্গির মত দেখতে হলেও তার আওয়াজটা সারেঙ্গির মাধুর্য অনুপস্থিত । একটু মোটা গান গাইতে গাইতে লোকটি যন্ত্রটিকে কোলের ওপরে ধরে তারের ওপরে ছড় চালিয়ে যে সুর তুলছিল তা গানের সুরের অনুবর্তন করছিলনা । অথচ কন্ঠ আর যন্ত্রের সুর কোন এক অশ্রুত আত্মীয়তা সুত্রে যেন বাঁধা ছিল । আর তাই সে গান বেসুরো মনে হয়নি । নিজের সংগীতচর্চার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি কাজটি কত কঠিন । গায়কের সামনে একটা চাদর পাতা তার ওপরে কিছু খুচরো পয়সা পড়ে রয়েছে দেখে পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার কয়েন বের করে সেই চাদরে ফেলে দিয়ে এগিয়ে চললাম ।
রাস্তাটার বাঁপাশের অভিজাত দোকানগুলির অনেক কটাই বেশ প্রাচীন ।তাদের কাচের শো কেসে সাজান নানা রকমের কিউরিও তার দাম ও বেশ চড়া । এ দোকানগুলিতে সাধারনত বিদেশী পর্যটকেরাই বেশি কেনাকাটা করে । উল্টোদিকে সার সার অস্থায়ী ঝুপড়ি দোকান । বাঁশের খাঁচার মাথায় ত্রিপলের ছাউনি তার তলায় তক্তপোষের অপরে সাজানো  নানান মনোহারী পশরা ।  উলের সোয়েটার , চামড়ার জ্যাকেট , পশমের টুপী , কম্বল , খেলনা , দার্জিলিং এর পাথর কি নেই সেখানে ! আর ভীড় ও উপচে পড়েছে সে সব দোকানে । বেশ লাগছিল সেই বিকিকিনির হাটের মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে । তবে একটা সময়ে অনুভব করলাম সন্ধ্যা নেমে এসেছে ঠান্ডাও বাড়তে শুরু করেছে সূর্যাস্তের পর থেকে । আর এগিয়ে ম্যালে যেতে ইচ্ছে করলনা ।ফিরে চললাম পান্থশালায় ।


                                                                          

সকালে ঘুম ভেঙে প্রথমেই মনে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা । যদিও দার্জিলিং এ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে স্বমহিমায় দেখতে পাওয়া যায় অনেক বেলা অবধি গতকাল এখানে পৌঁছে তার দেখা পাইনি । আশাছিল পরের দিন ভোরবেলা ঘুমচোখ খুলেই নতুন করে তার সঙ্গে শুভদৃষ্টি হবে ।সেই উৎসাহে প্রবল ঠান্ডার ভ্রূকুটি কে উপেক্ষা করে এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম । ঘরের ছোট্ট জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম পিছনের বাড়ির ছাদের আড়াল গলে যেটুকু আকাশ দেখা যায় সেই দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম কিন্তু কোথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ! মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশে  ,চারপাশের বাড়ির দেওয়ালে , গাছের মাথায় প্রভাতী রোদ্দুর ঝলমল করছে অথচ দিগন্তেরেখার প্রান্তে যেখানে গিরিরাজ হিমালয়ের সোনার মুকুট সকালের নরম রোদ্দুরে ঝিকিমিকি করতে থাকে তা ঘন কুয়াশায় মোড়া । কেমন যেন ঘোলাটে ভাব । নিশিতে পাওয়া লোকের মত ঘরের বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম , তবু সে অধরাই রয়ে গেল । উপায় নেই পাহাড়ের খেয়ালি প্রকৃতি এমনই । এই আছে এই নেই দুনিয়ার কোন আদালতে এর বিরুদ্ধে নালিশ চলেনা ।
কাজেই মনে ক্ষোভ জমিয়ে রেখে লাভ নেই । দ্রুত একতলার রেস্তরাঁয় বসে জলখাবারের পাট চুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ম্যালের উদ্দেশ্যে । তেমাথায় পৌঁছে বাঁদিকের রাস্তাটা চলে গেছে ম্যালের দিকে।সেদিকে ঘুরতে চোখে পড়ল এই রাস্তাটার ওপরের ধাপে একটা টী প্ল্যান্টারস এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনাধীন একটা হাসপাতাল ।দূর থেকে ব্যারাকের মত বাড়িটার চেহারা দেখে মনে হল হাসপাতালটা হয়ত সেই বৃটিশ আমলে তৈরী । রাস্তার ধারের বড় দোকান গুলো খোলেনি তখনো অন্য ধারে ঝুপড়ি দোকানগুলোতে দোকানিরা সবে বসতে শুরু করেছে ।রাস্তায় ভীড় ও নেই ।কেবল ছোট ছোট দলে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে চলেছে স্কুলের পথে । তাদের ইউনিফর্মের পারিপাট্য দেখে তাদের কোন অভিজাত স্কুলের পড়ুয়া বলেই মনে হল । ছেলেরা পরেছে হাল্কা নীলচে রঙের প্যান্ট ,ঊর্ধ্বাঙ্গে গাঢ় শ্যাওলা রঙের ব্লেজার ও টাই । ব্লেজারের বুক পকেটে স্কুলের ব্যাজ । মেয়েদের স্কার্টের সঙ্গে ছেলেদের মতই ব্লেজার ও টাই । প্রত্যেকের পিঠে স্কুল ব্যাগ । সকালের নরম রোদ্দুরে কচি কচি মুখ গুলোকে ফুলের মতই তাজা আর সুন্দর লাগল ।